শিরোনাম:
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১
Swadeshvumi
বৃহস্পতিবার ● ২৬ জানুয়ারী ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » ৫০ বছরে আরণ্যকের সংগ্রামী অগ্রযাত্রা
প্রচ্ছদ » জাতীয় » ৫০ বছরে আরণ্যকের সংগ্রামী অগ্রযাত্রা
২৫৮ বার পঠিত
বৃহস্পতিবার ● ২৬ জানুয়ারী ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

৫০ বছরে আরণ্যকের সংগ্রামী অগ্রযাত্রা

---
শাহনাজ পারভীন এলিস
প্রতিষ্ঠার ৫০ পূর্ণ করতে যাচ্ছে আরণ্যক নাট্যদল। ১৯৭২ সাল ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দলটির দীর্ঘ এই নাট্য অভিযাত্রায় ৪০টি মঞ্চ এবং ২৪টি নাটক দর্শকদের জন্য উপহার দিয়েছে। সুবর্ণজয়ন্তীর এই ক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে আয়োজন করা হয়েছে আট দিনের আরণ্যক নাট্যোৎসব। ‘থিয়েটারের নতুন বার্তা বিধ্বস্ত পৃথিবীর জন্য’ স্লোগানে আগামীকাল ২৭ জানুয়ারি শুরু হবে দলটির নাট্যোৎসব, চলবে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

---
এ উপলক্ষে বুধবার (২৫ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে দলটি পক্ষ থেকে জানানো হয়, উৎসবের এই আট দিনে আরণ্যকের নতুন ও পুরনো মিলে ৯টি নাটক মঞ্চস্থ হবে। সেই সঙ্গে শিল্পকলার বহিরাঙ্গনে থাকবে উন্মুক্ত অনুষ্ঠান। এছাড়াও রয়েছে সেমিনার, যন্ত্রসংগীত ও প্রকাশনা উৎসবসহ নানা আয়োজন। নাট্যোৎসবে প্রদর্শিত হবে- নানকার পালা, ওরা কদম আলী, ইবলিশ, সংক্রান্তি, ময়ূর সিংহাসন, রাজনেত্র, কবর, রাঢ়াঙ ও কহে ফেসবুক নাটক।
নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক মামুনুর রশীদ আরণ্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা। আজ থেকে ৫০ বছর আগে সদ্য যুদ্ধ ফেরত তরুণ এই শিল্পী গড়ে তুলেছিলেন এই নাটকের দল। তারপর সময়ের পরিক্রমায় আরণ্যকের নাটক নিয়ে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বহু দেশে। সুবর্ণজয়ন্তীর এই ক্ষণে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে দলপ্রধান মামুনুর রশীদ জানান, প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর উদযাপন একটি বড় ব্যাপার। এটা উদযাপন করতেই আমরা উৎসবের আয়োজন করছি। বেশ কয়েকটি পুরাতন নাটকও এই উৎসবে নতুন করে মঞ্চস্থ হবে। পাশাপাশি আমাদের নিয়মিত প্রযোজনাগুলোও থাকবে।

শিল্পকলা একাডেমিতে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন আরণ্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা মামুনুর রশীদ
মামুনুর রশীদ আরও জানান, ‘দীর্ঘ পথচলা শেষে সুবর্ণজয়ন্তীর এই অনুষ্ঠান উদযাপন করতে গিয়ে অনেক কিছু মনে পড়ছে। অনেক কিছুর বিনিময়ে আমার এবং সবার ভালোবাসার নাটকের দল আরণ্যক আজ এ পর্যায়ে এসেছে। তাই আরণ্যকের ৫০ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা। কখনো ভাবিনি আরণ্যক নাট্যদলের ৫০ বছর দেখে যেতে পারব। সেই বিরল সুযোগ আমার জীবনে ঘটেছে। আমি সত্যি আনন্দিত। সবার ভালোবাসায় আরণ্যক ৫০ বছর পার করছে। এজন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। অনেক সংকট পার করেছি। অনেক সংগ্রাম পার করেছি। অনেক কিছুর বিনিময়ে সবার ভালোবাসায় আরণ্যক ৫০ বছরের পথচলা সার্থক হয়ে উঠেছে।

একনজরে আরণ্যক

প্রতিষ্ঠাকাল: ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সাল
প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য : ৭ জন
প্রথম নাটক: কবর, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
মোট প্রযোজিত মঞ্চনাটক: ৪০টি
মঞ্চস্থ পথনাটক: ২৪টি
বর্তমান নিয়মিত সদস্য: ৮০

শুরু থেকে আরণ্যক নাট্যদল নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণিসংগ্রামের সুতীক্ষ্ম হাতিয়ার- এই স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে। মঞ্চ নাটক, পথ নাটক ও মুক্ত নাটক করে নাট্যচর্চাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সবার ভালোবাসা নিয়ে আগামীতে আরণ্যকের পথচলা আরও সমৃদ্ধ হবে বলে বিশ^াস রাখি।’
দলের প্রতিষ্ঠাকালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মামুনুর রশীদ বলেন, দলের ‘আরণ্যক’ নামটি দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। টেলিভিশনে বসে আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বলেছিলাম, ‘একটা নাটকের দল করব, কী নাম দেওয়া যায়?’ আবদুল্লাহ আল মামুন বললেন, ‘নাগরিক তো আছেই, তোমরা আরণ্যক হয়ে যাও।’ তারপরই নাম দিলাম আরণ্যক।’
প্রথম নাটক কবর-এর দৃশ্যে প্রয়াত আলী যাকের ও সুভাষ দত্ত। ছবি: আরণ্যকের সৌজন্যে
কবর-এর পর ওই বছরই মঞ্চে আনা হয় ‘পশ্চিমে সিঁড়ি’। ১৯৭৬ সালে মঞ্চে আসে ‘ওরা কদম আলী’ নাটক। এই নাটকের সংলাপে মানবিক মূল্যবোধ, শ্রেণিসংগ্রাম আর প্রতিরোধের চেতনা স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। ১৯৭৯ সালে আরণ্যকের প্রযোজনা ‘ওরা আছে বলেই’। গ্রাম থেকে ভেসে আসা মানুষের সংঘবদ্ধ টিকে থাকার চিত্র এই নাটক। আরণ্যকের জনপ্রিয় প্রযোজনা ‘ইবলিশ’ এসেছিল ১৯৮১ সালে। দলের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, মান ও বক্তব্যের বিচারে ‘ইবলিশ’ অনেক উচ্চাকাক্সক্ষী নাটক। নাট্যচর্চার পালাবদল প্রথম ১০ বছরে ‘কবর’ থেকে ‘ইবলিশ’ পর্যন্ত আরণ্যক প্রযোজিত নাটক প্রদর্শনীর সংখ্যা ছিলো ১৭৮।
এ প্রসঙ্গে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘প্রথম ১০ বছরে নাট্যচর্চার অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পারি, মহিলা সমিতি বা অন্য কোনো মিলনায়তনের সীমিত আসনের মঞ্চে নাটককে কখনোই প্রচলিত বিনোদনের ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। অভিনেতা ও মধ্যবিত্ত দর্শকের মধ্যে একটা দূরত্ব থেকেই যাবে। এমন উপলব্ধি থেকে নাট্যচর্চায় পরিবর্তন আনে আরণ্যক। বেছে নেয় সহজতর ও জীবনঘনিষ্ঠ উপস্থাপনা।

---
১৯৮২ সালে মুক্তনাটকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরণ্যক মঞ্চে আনে আবদুল্লাহেল মাহমুদ রচিত ‘সাত পুরুষের ঋণ’। ১৯৮৬ সালে ‘নানকার পালা’ আরণ্যকের নাট্যচর্চার আরেকটি পালাবদল। মামুনুর রশীদ জানান, ‘নানকার পালা’ মঞ্চে আসার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা আর স্বৈরাচারী নির্যাতনের কালে ব্যাহত হলো স্বাভাবিক নাট্যচর্চা। এ সময় মঞ্চ ছেড়ে পথে নেমে এল আরণ্যক। মিছিল, বিক্ষোভ আর পথনাটক এক হয়ে গেল।
১৯৯২ সালে আরণ্যক মঞ্চে আসে মামুনুর রশীদের ‘পাথর’। ধর্ম নিয়ে উপমহাদেশের বাস্তবতার পাশাপাশি এ নাটকে মানুষের মহত্ত্বের সম্ভাবনা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্র উঠে এসেছে। ১৯৯৪ সালে মান্নান হীরার ‘আগুনমুখা’ নাটকে উঠে এসেছে বিপ্লব আর বিপ্লবীদের কথা। বিতর্ক, দলাদলি, বিভক্তির নানা চিত্রের শৈল্পিক বিশ্লেষণধর্মী আগুনমুখা। পরের বছর ১৯৯৫ সালে মামুনুর রশীদ মঞ্চে নিয়ে আসেন তার বহুল প্রশংসিত নাটক ‘জয়জয়ন্তী’। এ নাট্যাখ্যান মুক্তিযুদ্ধের, স্বাধীনতার, মুক্তির ও জাগরণের।
তারপর আবার মঞ্চে এলো ভিন্ন রং। ১৯৯৭ সালে ‘প্রাকৃতজন কথা’ নাটকে হাজার বছর আগের ইতিহাসের এক বিশেষ ক্রান্তিকালকে তুলে আনলেন আবদুল্লাহেল মাহমুদ। ১৯৯৯ সালে মঞ্চে আসে মান্নান হীরা রচিত ‘ময়ূর সিংহাসন’। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে একটি মফস্বল শহরে স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরোধ- এ নাটকের বিষয়। ২০০০ সালে ‘সংক্রান্তি’ নাটকে উঠে আসে গ্রামের লোকনাট্য ‘সঙ’-এর সঙ্গে কৃষিজীবী মানুষের জীবন ও শিল্পের বিরোধ এবং উচ্চবিত্ত মানুষের কাছে তাদের অবহেলার চিত্র।

আরণ্যকের ‘রাঢ়াঙ’ নাটকের দৃশ্যে চঞ্চল চৌধুরী ও অন্য অভিনয়শিল্পীরা
সাঁওতালদের ভূমি লুণ্ঠনসহ নানা নির্যাতনের কাব্যিক ঘটনা নিয়ে ২০০৪ সালে মঞ্চে আনা হয় প্রযোজনা ‘রাঢ়াঙ’। ২০১৪ সালে আরণ্যক মঞ্চে আনে মামুনুর রশীদের ‘ভঙ্গবঙ্গ’। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সঙ্গে আজকের সময়কে সমন্বয় করে রূপকধর্মী নাটক ভঙ্গবঙ্গ। ২০১৬ সালে মঞ্চে আসে মান্নান হীরা রচিত ‘দি জুবলী হোটেল’। নাটকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, হত্যা, গুম, ধর্ষণ, নির্যাতন—সর্বোপরি জঙ্গিবাদের উত্থানের নানা গল্প উঠে এসেছে। ২০২০ সালে আসে আরণ্যকের ৬২তম প্রযোজনা ‘কহে ফেসবুক’।
মামুনুর রশীদের রচনা ও নির্দেশনায় ‘কহে ফেসবুক’ প্রযুক্তির প্রতি মানুষের মোহগ্রস্ততা এবং এর ফলে সৃষ্ট মানবিক সম্পর্কের সংকটের প্রামাণ্য দলিল। এখন পর্যন্ত আরণ্যকের সর্বশেষ প্রযোজনা ‘রাজনেত্র’। ক্ষমতাসীনেরা কখনো কিছু স্বাভাবিক চোখে দেখে না, সবার চোখে থাকে একই রাজনেত্র। ক্ষমতার পালাবদল হয়, কিন্তু এই বিশেষ দৃষ্টি বদলায় না, এই হলো এ নাটকের বিষয়।

‘রাজনেত্র’ নাটকের কারিগরি প্রদর্শনীর একটি দৃশ্য। ছবি: আরণ্যকের সৌজন্যে
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নাট্যচর্চায় যাত্রা শুরু আরণ্যক নাট্যদলের। ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি শহীদ মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক দিয়ে প্রথমবার মঞ্চে আসে তারা। আরণ্যকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ৭, বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৮০ জন। মোট প্রযোজনা ৪০টি, আর পথনাটক ২৪টি। প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৫০ বছরে মঞ্চনাটক, পথনাটক ও মুক্তনাটক করে নাট্যচর্চাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে দলটি। এই পথচলায় ৪০টি মঞ্চনাটক ও ২৪টি পথনাটকের শত শত প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে আরণ্যক। বিচিত্র ও সংগ্রামী এই নাট্যযাত্রায় আরণ্যক এখন আরও বেশি তারুণ্যদীপ্ত ও পরিণত। তাই নাটকের ভাষায় আরণ্যক সমাজের নানা অসঙ্গতি ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরবে এবং শোষণহীন মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে তাদের নিরন্তর সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে এমনই প্রত্যাশা সবার।

---



বিষয়: #



আর্কাইভ