শুক্রবার ● ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » ধর্মীয় শিক্ষালয়ে শিশু নির্যাতন ও হত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধ
ধর্মীয় শিক্ষালয়ে শিশু নির্যাতন ও হত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধ
মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের মানববন্ধনে বক্তারা
গত ৪ বছরে বিভিন্ন মাদ্রাসা ও মক্তবে নির্যাতনে ৮১ শিশুর মৃত্যু
বিশেষ প্রতিনিধি
দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা-মক্তবে গেলো চার বছরে বিভিন্ন মাদ্রাসা ও মক্তবে ৮১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে গত ২০২২ সালেই মৃত্যু হয়েছে ২৬ শিশুর। গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের মানববন্ধনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। এসময় সংগঠনটির পক্ষ থেকে- ধর্মীয় শিক্ষার নামে চলা এ ধরনের শিশু নির্যাতন ও হত্যাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং ওইসব হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাসহ ২৪ দফা দাবি জানানো হয়।
এসময় মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের আহ্বায়ক সাইফুল বাতেন টিটু জানান, গত চার বছরে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য তারা পেয়েছেন। এই সময়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭২৯টি, ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ১৬২, অমানবিক নির্যাতনের শিকার ৩২৫ শিশু, নির্যাতনে অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হয়েছে ১০ জন, গুম অথবা নিখোঁজ রয়েছে ৩৫ জন এবং নির্যাতনের পর শিকলে বাঁধা পড়েছে ৬ জন শিশু।
এসময় দীর্ঘদিন ধরে চলা দেশের মাদ্রাসা-মক্তবে শিক্ষার নামে এ ধরনের শিশু হত্যা ও নির্যাতন বন্ধে ২৪ দফা দাবি তুলে ধরেন শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের আহ্বায়ক সাইফুল বাতেন টিটু। তিনি জানান, এসব তথ্য শুধু গণমাধ্যম থেকেই সংগ্রহ করা হয়নি, ছদ্মবেশে তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসায় সরজমিন তদন্ত করে এসব ঘটনার সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন। সেসব অনেক ঘটনার তথ্য-প্রমাণও তার কাছে রয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, এদেশের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের জন্য একশ্রেণির ধর্মীয় এই শিক্ষকরা অভিভাবকদের বোকা বানাচ্ছেন এবং তাদের শিশুর জীবন বিপন্ন করে বিপথে ঢেলে দিচ্ছেন, যার অবসান হওয়া জরুরি। টিটু আরও জানান, এসব ঘটনার বিচার এবং অনিয়ম-নির্যাতন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তাদের এই প্রতিরোধ-আন্দোলন অব্যাহত থাকবে; এবং প্রয়োজনে সারাদেশে একযোগে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. মাদ্রাসা-মক্তবে শিক্ষার নামে শিশু নির্যাতন ও হত্যাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। একই সাথে এ পর্যন্ত যতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ২. আবাসিক শিক্ষা বন্ধ করা এবং ১২ বছরের নিচের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে নারী শিক্ষক দ্বারা পাঠদান বাধ্যতামূলক করা। ৩. আরবি ও কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি সকল সাধারণ পাঠ্যক্রম পাঠ্যতালিকায় রাখা। ৪. প্রতিটি মাদ্রাসা, হেফজখানা ও মক্তবকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত করা। ৫. প্রতিটি মাদ্রাসা, হেফজখানা ও মক্তবে একজন নিয়মিত চিকিৎসক থাকতে হবে।
৬. কোন শিক্ষার্থী অসুস্থ হলে তাকে সাথে সাথে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং অভিভাবক ও নিকটস্থ থানায় জানাতে হবে, অন্যথায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৭. কোন শিক্ষার্থীকে মাদ্রাসার কোন শিক্ষক অথবা বড় ছাত্র তাদের ব্যক্তিগত কোন খেদমতের জন্য ব্যবহার করতে পারবে না। ৮. বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং বনভোজনের ব্যবস্থা রাখা। ৯. দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে খেলাধুলা করার ব্যবস্থা রাখা। গান শোনা, টিভি দেখা, বেতার শোনা ও সঙ্গীত চর্চার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং দেশের ভেতর লভ্য এবং অনুমোদিত সকল ওয়েব পাতা প্রদর্শন করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
১০. ১৮ বছরের নিচে কোন শিক্ষার্থীকে কোন ধরনের সভা, সমাবেশ, মিটিং, মিছিল ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠানে নেয়া যাবে না। ১১. মাদ্রাসা, হেফজখানা ও মক্তব কর্তৃপক্ষের অবহেলায় যদি কোন শিক্ষার্থীর অপমৃত্যু হলে তার দায় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে এবং ওই শিক্ষার্থীর পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ১২. প্রতিটি হাসপাতালে এবং থানায় মাদ্রাসা, হেফজখানা ও মক্তবের শিক্ষার্থীদের জন্য ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার চালু করা। ১৩. প্রতিটি মাদ্রাসা, হেফজখানা ও মক্তবে একজন করে মনো-উপদেষ্টা থাকতে হবে, যিনি কোন প্রকার লাভ বা ক্ষতির সাথে জড়িত থাকবেন না। তিনি প্রতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের সাথে বসে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন এবং সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
১৪. মাদ্রাসা, হেফজখানা ও মক্তবের প্রতিটি গোসলখানা এবং শৌচাগারের দরজায় সিসি ক্যামেরা রাখতে হবে, যাতে সেই জায়গাগুলোতে দুজন মানুষ এক সাথে প্রবেশ করতে না পারে। ১৫. একটি কক্ষের কোন জায়গা সিসি ক্যামেরার আওতায় না থাকলে সেখানে কোন শিক্ষক বসতে বা শুতে পারবে না। ১৬. মাদ্রাসাকে এতিমখানা করা যাবে না। কারণ মাদ্রাসার সাথে এতিমখানার কোন প্রকার সম্পৃক্ততা থাকতে পাওে না। ১৭. এতিমদের জন্য প্রতিটি থানায় আলাদা করে একটি নির্দিষ্ট পুনর্বাসন কেন্দ্র অথবা এতিমখানা করতে হবে, যাতে করে এতিমদের পুঁজি করে এক শ্রেণির অসাধু ধর্ম-ব্যবসায়ীরা পাড়া-মহল্লায়, আনাচে-কানাচে ধর্ম-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসতে না পারে, এবং এতিম বাচ্চাগুলোকে সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতে না হয়।
১৮. মাদ্রাসার কোন ছাত্রকে দিয়ে ভিক্ষাবৃতি করানো যাবে না, কোরবানির চামড়া তোলা যাবে না। ১৯. আঠারো বছরের নিচের ছাত্রদের দিয়ে কোরবানির পশু জাবেহ করানো যাবে না, মাংস কাটানো যাবে না। ২০. নারীদের মাদ্রাসা, হেফজখানা ও মক্তবে পুরুষ মুহতামিম থাকতে পারবে না। ২১. ১৮ বছরের নিচে ছেলে শিক্ষার্থীদেরকে নারীদের হায়েজ-নেফাস (মাসিক)সহ মেয়েলি মাসআলা-মাসায়েল (ইসলামি বিধি-বিধান) এর শিক্ষা দেওয়া যাবে না। ২২. প্রায় প্রতিটি মাদ্রাসা, হেফজখানা ও মক্তবে শিক্ষার্থীদের পোশাক কৃত্রিম কাপড়ে তৈরি করা হয় এবং এতে করে দিনে অনেকটা সময় তাদের শরীর আপাদমস্তক অস্বস্তিকর পোশাকে ঢাকা থাকে। এতে তাদেও শরীরে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়। তাই সকল শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিক পোশাক হিসেবে আরামদায়ক সুতি কাপড়ের পোশাক দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের উদ্যোগে আয়োজিত এই মানববন্ধনে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এসময় তারা বলেন, একশ্রেণির অসাধু ধর্ম-ব্যবসায়ীর উদ্যোগে ধর্মীয় শিক্ষা এবং এতিম শিশুদের পুনর্বাসনের নামে দেশের আনাচে-কানাচে মাদ্রাসা ও মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেসব প্রতিষ্ঠানে শিশুদের আসলে কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়ম ও নির্যাতন বন্ধে সরকারি নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান বক্তারা।
বিষয়: #ধর্মীয় শিক্ষালয়ে শিশু নির্যাতন ও হত্যা মানবতাবিরোধী অপর