মঙ্গলবার ● ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » সাহাবুদ্দিন চুপ্পু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত
শাহনাজ পারভীন এলিস
দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। সোমবার দুপুরে নির্বাচন ভবনে এই নির্বাচনের নির্বাচনী কর্তা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনী ফরম বাছাই শেষে সাহাবুদ্দিনের মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়ায় তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। তার ঘোষণার পরপরই এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন, ১৯৯১ (১৯৯১ সনের ২৭নং আইন) এর ধারা ৭ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বিধিমালা, ১৯৯১ এর বিধি ১২ এর উপ-বিধি (৬) অনুসারে নির্বাচনি কর্তা ও নির্বাচন কমিশনার এর ঘোষণা মোতাবেক জনাব মো. সাহাবুদ্দিন, পিতা-মরহুম শরফুদ্দিন আনছারী, বাসা/হোল্ডিং-৮৮/১, গ্রাম/রাস্তা: শিবরামপুর, পাবনা পৌরসভা, ডাকঘর-পাবনা, পোস্ট কোড-৬৬০০, উপজেলা-পাবনা সদর, জেলা-পাবনা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করা হয়েছে।’
এর আগে ইসি সচিবালয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণাকালে সিইসি সাংবাদিকদের জানান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্য জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় ছিল। এই সময়ের মধ্যে দাখিলকৃত মনোনয়নপত্র পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে মাত্র একজনের মনোনয়ন বৈধ থাকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন, ১৯৯১ (১৯৯১ সনের ২৭নং আইন) এর ধারা ৭ অনুসারে মো. সাহাবুদ্দিনকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ১২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত সময়ে মো. সাহাবুদ্দিনের নামে দুটি মনোনয়নপত্র জমা পড়ে। ১৩ ফেব্রুয়ারি বাছাইয়ের সময় তার মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়ায় আরেকটি মনোনয়নপত্র গ্রহণের আবশ্যকতা ছিল না।’ মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর প্রস্তাবক আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সমর্থক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ ও আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন।
মো. সাহাবুদ্দিন আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। এর আগে রোববার সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সকালে তার পক্ষে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে মনোনয়নপত্র জমা দেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। এসময় সাহাবুদ্দিন নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর পরিচয়
মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর জন্ম পাবনায়, ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। তার বাবা শরফুদ্দিন আনছারী ও মা খায়রুন্নেসা। তার বাড়ি পাবনা সদর থানার শিবরামপুরে। তিনি ঢাকায় থাকেন গুলশানে। তিনি পাবনা শহরের পূর্বতন গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমিতে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করার পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর পথচলা। পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও দীর্ঘদিন ওই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রলীগ নেতা হিসেবেই তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি পাবনা জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি পাবনা অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিনি পরে যুবলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন।
১৯৭৪ সালে জেলা যুবলীগের সভাপতি হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে তার প্রতিবাদ জানান তিনি। তখন গ্রেফতার হয়ে বেশ কয়েক বছর জেল খাটেন সাহাবুদ্দিন। এ সময় তিনি নির্যাতনেরও শিকার হন। জেল থেকে বের হয়ে তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পাশাপাশি আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর দুই বছর আইনজীবী হিসেবে যুক্ত থাকার পর ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে তিনি মুন্সেফ (সহকারী জজ) পদে যোগ দেন। সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ১৯৯৫ সালে পর পর দু’বার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। বিচারিক কাজের পাশাপাশি তিনি (১৯৯৬-২০০১) প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ডেস্ক অফিসার হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা তদন্তে পরবর্তী সময়ে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান (সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদমর্যাদায়) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চুপ্পু। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার কারণ ও সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিশনের দাখিলকৃত প্রতিবেদন সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করে।
কর্মজীবনে তিনি যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ পদে দায়িত্ব পালন শেষে ২৫ বছর পর ২০০৬ সালে অবসরে যান। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর ২০১১ সালের ১৪ মার্চ তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত কথিত পদ্মা সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের মিথ্যা ও অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণে সমর্থ হন। তার তৈরি তদন্ত প্রতিবেদন কানাডার আদালতেও সমর্থিত হয়। সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে চট্টগ্রামের জেএমসি বিল্ডার্স লিমিটেডের পক্ষে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। এখনও তিনি ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান।
আওয়ামী লীগ সভাপতি তার গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য হিসেবে চুপ্পুকে মনোনয়ন দেন। দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচটি ইমামের মৃত্যুতে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত শূন্য থাকা পদটিতে গত বছর (২০২২) ১৪ জানুয়ারি তাকে চেয়ারম্যান করা হয়। সাহাবুদ্দিন চুপ্পু এখনো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। পেশাগত জীবনে প্রথম দিকে তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি পাবনা প্রেসক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য।
বিষয়: #সাহাবুদ্দিন চুপ্পু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত