মঙ্গলবার ● ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » শব্দ দিয়ে নারীকে জব্দ করা বন্ধ হবে কী?
শব্দ দিয়ে নারীকে জব্দ করা বন্ধ হবে কী?
ভাষা প্রয়োগে নারী নির্যাতন
# শহরে ৯০ ভাগ নারী আপত্তিকর মন্তব্যের শিকা
# নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় লড়াই হতে হবে ভাষা প্রয়োগেও
শাহনাজ পারভীন এলিস
‘এই কন্ডাক্টর বাসে সিট নাই, তাহলে মহিলা তুললি কেন? আরে আপা আপনিই বা এটা কী করলেন- দেখলেন সিট নাই তারপরও উঠতেই হবে!’ -সম্প্রতি রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় দিশারী পরিবহনের একটি বাসে উঠা অফিসগামী এক নারীর প্রতি এমনই উক্তি করলেন মধ্যবয়সী এক পুরুষ যাত্রী। অথচ তিনি ওই বাসে নারীদের জন্য নির্ধারিত আসনটি বসে আছেন।
এছাড়া কলেজগামী কোন তরুণীকে বাস্তায় দেখে একদল যুবকের উক্তি হলো- ‘ওই দেখ মাল যাচ্ছে’ অথবা ‘সুন্দরী চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে’- এমন কোন গানের কলি ছুঁড়ে দেয়া বা চোখে-মুখে বিকৃত ভঙ্গি করে কোন নারীর প্রতি তিরস্কারমূলক কিছু শব্দ ছুড়ে দিয়েও নারীদের উত্ত্যক্ত বা ইফ টিজিং করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় কালো, বেটে, তালপাতার সেপাই, মাল, খানকি, মাগি- এরকম নানা শব্দ দিয়ে নারীকে মানসিক নির্যাতন করা হয়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা ফাহমিদা আকতার (৩৫)। তিনি পুরানা পল্টন এলাকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। যাতায়াতের সময় বেশিরভাগ সময় তিনি বাসে চড়েই অফিসে যান। তার সাথে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংবাদ সারাবেলাকে তিনি বলেন, ‘কী আর বলবো আপা, অল্প বেতনের একটি চাকরি করি। অফিসের নিজস্ব যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় বাসেই যেতে হয়। বাসে উঠার সময় প্রায়ই কুরুচিপূর্ণ লোকদের মন্তব্য শুনতে হয়। বাজে মন্তব্য করে বাসে উঠতে বাধাও দেয়া হয়। অনেক সময় কোনরকমে বাসে উঠতে পারলেও, সিটে বসতে দেয়া দূরে থাক- দাঁড়িয়ে যাওয়ার স্পেসটুকুও তারা ছেড়ে দিতে চায় না। এসব ঘটনায় মাঝেমধ্যে প্রতিবাদ করলেও অন্য যাত্রীদের আবার নানা উক্তি- ‘অনেক বলেছেন এখন থামেন’, ‘বাসে উঠলে একটু ঢেলা-গুতা তো লাগবোই, তাইলে প্রাইভেট কারে যাবেন’। কেউবা আবার কন্ডাক্টরের উদ্দেশ্যে বলে- ‘তোরে এজন্যই কইছিলাম মহিলা উঠাবি না, খালি ক্যাচাল করে।’
বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, শহরাঞ্চলে প্রায় ৯০ ভাগ নারী পথচারী কর্তৃক আপত্তিকর নানা মন্তব্যের শিকার হয়ে থাকেন। নারীকে কেন্দ্র করে গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের গালি দেওয়া প্রবণতা আরও বেশি। আর দৈনন্দিন জীবনে হরহামেশা ব্যবহৃত এসবের গালির কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহারের মূলে রয়েছে- নারীকে অবদমন করে পুরুষতন্ত্র টিকিয়ে রাখার চেষ্টা।
একশনএইড এর অনলাইন মাধ্যমের ওপর পরিচালিত অপর এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের ৬৩.৫১ শতাংশ নারী অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার; যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ সহিংসতার ঘটনাপ্রবাহ বেড়েই চলেছে। অনলাইনে বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মধ্যে নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন ফেসবুকে; যা ৪৭.৬০ শতাংশ। এরপর ম্যাসেঞ্জার, ইনস্ট্রাগ্রাম, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইউটিউবে অনলাইন মাধ্যমে। এছাড়া ৪.৮০ শতাংশ নারী বলেছেন, তারা ভিডিও কল, মোবাইল ফোন এবং এসএমএস’র মাধ্যমেও হয়রানির সম্মুখীন।
সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ সংবাদ সারাবেলাকে বলেছেন, গত বছর এ বিষয়ে তারা একটি জরিপ করেছিলেন। সেই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৬৯ দশমিক ৯২ শতাংশ তরুণী তাদের শারীরিক অবয়ব নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হন। ওজন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হন ৩৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ তরুণী। তাদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ২৪ শতাংশ তরুণীর বক্তব্য হলো- শরীরের আকৃতি, গঠন এবং অবয়ব নিয়ে আত্মীয়রাই কথায় ও ইঙ্গিতে হেয় প্রতিপন্ন করেন তাদের। এছাড়াও বন্ধুবান্ধবের কাছে ২২ ভাগ তরুণী বডি শেমিংয়ের শিকার। এছাড় ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ তরুণী পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও এ ধরনের নেতবিাচক মন্তব্য শুনেছেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনের নানা নতুন ধরন যুক্ত হচ্ছে। নারীর প্রতি ঘৃণার ভাষায় কথা বলাটাকে এক শ্রেণির পুরুষ বড় কৃতিত্ব বা পৌরুষত্বের কাজ মনে করে। তাই তারা কারণে অকারণে এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাষায় কথা বলে। পুরুষের গালাগাল এবং হীন আচরণ যেন একমাত্র নারীর প্রাপ্য। নারীর অগ্রযাত্রাকে, ভালো দিকগুলোকে তারা ইতিবাচক ভাবতে পারে না।’
নারীর প্রতি কুরুচিপূর্ণ ভাষার প্রয়োগ যে শুধু সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষেরা করে তা নয়, অনেক সময় উচ্চশ্রেণির শিক্ষিত সুধীজনদের মুখেও এ ধরনের শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় সামাজিক বা পারিবারিক ঝগড়া বিবাদের সময়ও নারীরা মৌখিক সহিংসতার শিকার হন। কোন কোন সময় মৃত্যুও পর নারীকে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে গালাগাল দেয়া হয়- বোঝানোর চেষ্টা করা হয় মৃত্যুটা যেন তার অবধারিত ছিলো। অথচ তাকে যিনি নির্যাতনের পর হত্যা করেছেন তিনি যেন বীরপুরুষ। ওইসব কলঙ্কিত পুরুষ সমাজে মাথা উঁচু করে পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে থাকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারীপক্ষের অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট ফেরদৌসী আকতার বলেন, ‘মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা। এর মাধ্যমেই আমরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি। একজন ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য শুধু তার আচার আচরণেই প্রকাশ হয় না, কথা বলার সময় ওই লোকটি কী ভাষা ব্যবহার করলেন তা থেকেও বোঝা তার ব্যক্তিক ও পারিবারিক শিক্ষার অবস্থা। কারণ এই ধরনের আচরণ ও ভাষা যারা প্রয়োগ করেন- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা অভ্যাসগত। কারণ পরিবার হলো প্রত্যেক মানুষের প্রথম শিক্ষালয়। সেখানে তার শিশুটি অন্য নারীদের প্রতি কী ধরনের মনোভাব প্রকাশ করবে, আর কোনগুলো করবে না তার চর্চা শুরু হয়। পরবর্তীতে ওই শিশু বড় হয়ে ব্যক্তিক জীবনেও সেই আচার-আচরণের চর্চা বা প্রয়োগ অব্যাহত রাখেন।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে নারীকে শিক্ষার অভাব, কুপমণ্ডুকতা, কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেদ থেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে হবে। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। শব্দের মাধ্যমে নারীকে জব্দ করার যে কৌশল তা রুখে দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেছেন, নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে গুরুত্ব দেয়া জরুরি। সচেতনতার পাশাপাশি তাদের পর্যাপ্ত মানসিক সমর্থন আদায় করতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে নারী অবহেলা ও অসম্মানের পাত্র নয়। এসব ঘটনায় আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। সচেতনতা গড়া কার্যক্রম শুরু করতে হবে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীর প্রতি অসংবেদনশীল শব্দের ব্যবহার নারীর অগ্রযাত্রাকে অনেকখানি থামিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, অসম্মানজনক ভাষার ব্যবহার নারীর আত্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেন শব্দচক্রে জর্জরিত নারীর জীবন। মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। তাই মায়ের সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভাষায় নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।