বুধবার ● ৫ এপ্রিল ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » ‘সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো, এখন লোনের টাকা শোধ করবো কেমনে’
‘সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো, এখন লোনের টাকা শোধ করবো কেমনে’
-আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর আহাজারী
# আগুনে কয়েক হাজার ব্যবসায়ীর স্বপ্নভঙ্গ
শাহনাজ পারভীন এলিস
‘আজই আমার ৪ হাজার মাল ওমানে ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিলো। ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা লোন করে ঈদের আগেই দোকানে মালামাল উঠিয়েছিলাম। ক্যাশে নগদ টাকাও ছিলো ৭ লাখের মতো। কিন্তু আগুনে আমার দোকানের সব মালামাল পুড়ে গেলো। এখন আমি লোনের টাকা শোধ করবো কেমনে।’ গতকাল মঙ্গলবার বঙ্গবাজার এলাকায় গিয়ে গুলিস্তানের এনেক্সো টাওয়ারের সামনে বসে এভাবেই আহাজারি করছিলেন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মারুফ হোসেন। বঙ্গবাজারের নিচতলায় দুটি দোকান ছিলো তার। একটি দোকানের মালামালও তিনি আগুন থেকে বাঁচাতে পারেননি।
পুরান ঢাকার কায়েতটুলি এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল আলম। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে তিনি এই বঙ্গবাজারে ব্যবসা করছেন। ‘রুবেল গার্মেন্টস’ নামে তার রেডিমেট শার্টের দুটি দোকান ছিলো। করোনার প্রভাব কেটে যাওয়ায় এবার ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যাংক লোনসহ ধারদেনা করে প্রায় কোটি টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন। জিজ্ঞেস করতেই সিরাজুল বলেন, ‘আপা, আগুনে আমি শেষ হয়ে গেছি। ৮ লাখ টাকা ব্যাংক লোন, ১৫-২০ লাখ টাকার ধারদেনা এখন কীভাবে শোধ করবো ভেবে পাচ্ছি না। কোথায় যাবো, কী করবো, সংসার কীভাবে চলবে কিছুই বুঝে পাচ্ছি না।’
ব্যবসায়ী আয়েন উদ্দিন জানান, ‘৯ মাস আগে নতুন দোকান নিয়েছি। আজ সকালে কয়েক পার্টিকে মালের টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। শুরুর আগেই সবকিছু শেষ। দোকানে নগদ ৭ লাখ টাকা আর ৬ লাখ টাকার মালামাল ছিল। এখন কিছুই নাই।’ ১৪ লাখ টাকার পাঞ্জাবি, নগদ আড়াই লাখ টাকা পুড়ে গেছে জানিয়ে গার্মেন্টসের দোকানি মিলন বলেন, ‘মার্কেটে আমাদের তিনটি দোকান। তিনটাই পুড়ে ছাই। নিজের ৭ লাখসহ ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এবার ঈদে মাল উঠিয়েছিলাম। কিছুই নাই। ক্যাশে আড়াই লাখ টাকা ছিল। ব্যাংক থেকে প্রতিদিন টাকা উঠাতে ঝামেলা দেখে দোকানেই টাকা রেখেছিলাম। এখন ছাই ছাড়া কিছু নাই।’
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে শাড়ি-কাপড়ের ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলাম বাবুল। হামদান শাড়ি বিতানের মালিক তিনি। বিগত ২৩ বছর যাবত এ মার্কেটে ব্যবসা করে আসছেন। হামদান শাড়ি বিতান নামে ব্যবসা শুরু করেছেন বছর চারেক আগে। পুড়ে যাওয়া মার্কেটের অদূরে সড়কের আইল্যান্ডে কয়েকটা কাপড়ের গাঁটের পাশে দাঁড়ানো তিনি। অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্ব হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছেন। জানতে চাইলে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘প্রায় ৫০ লাখ টাকার মালামাল ছিল তার দোকানে। ঈদ বাজারের কারণে ঋণ করে দোকানে অতিরিক্ত মালামাল তুলেছিলেন। এখন আর কিছুই নাই। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মার্কেটের অস্তিত্বই এখন আর নাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের পাশের সড়কের ফুটপাতে কিছু কাপড়ের গাঁটের সঙ্গে হেলান দিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন মল্লিকা গার্মেন্টসের মালিক নূর আলম। সব হারিয়ে দিশেহারা। বলছিলেন, দোকানের ক্যাশ বাক্সেই ছিল আট লাখ টাকা। মহাজনের টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে টাকাগুলো রেখেছিলেন দোকানে। সঙ্গে ৩০ লাখ টাকারও বেশি মালামাল ছিল তার। কিছুই আর বাকি নাই।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতি ‘খ’ ইউনিট-এর সভাপতি লোকমান খান বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রায় তিন হাজার দোকান। ঈদে প্রতিটি দোকানে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকার মাল থাকে। কোনও কোনও দোকানে ১০ কোটি টাকারও পুঁজি থাকে। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবদার, দ্রুত আর্থিক সহয়তার মাধ্যমে পুর্নবাসন করানো হোক।’
ব্যবসায়ী মকবুল জানান, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে পাশাপাশি মার্কেট রয়েছে পাঁচটি। এরমধ্যে আদর্শ হকার্স মার্কেট, বঙ্গ গুলিস্তান, এনেক্সকো মার্কেট ও মহানগর শপিং কমপ্লেক্স। এছাড়াও বিপরীত পাশে ইসলামিয়া মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে বঙ্গ ও আদর্শ হকার্স মার্কেটের আর কিছু অবশিষ্ট নাই। এ মার্কেটের ঠিক পিছনে পূর্বপাশে পুলিশ সদর দপ্তর। মার্কেটের আগুন গিয়ে লাগে পুলিশ সদর দপ্তরের বাউন্ডারির ভেতরে ব্যারাক ভবনে।
আগুন লাগার পর থেকে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীদের ভিড় বাড়তে থাকে বঙ্গবাজার এলাকায়। একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল পর্যন্ত। অন্যদিকে পুলিশ সদর দপ্তর হয়ে পাশের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভবন পর্যন্ত। পুরো সড়কেই ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার, সেনাবাহিনী, রেডক্রিসেন্ট, ওয়াসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যানবাহনে ছিল অবরুদ্ধ। এছাড়া উৎসুক জনতার বিড়ম্বনায় হিমশিম খাচ্ছিলেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ব্যারাক ভবনের নীচে পলমার্ট নামের একটি শপ ছিল। সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যারাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রহমান বলেন, শুধু মহানগর মার্কেটেই ৮০০ দোকান রয়েছে। যেগুলোর বেশিরভাগই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, বঙ্গ ও আদর্শ মার্কেটেই ২৩৭০টি দোকান ছিল। এখন আর কিছুই নেই।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেলো, ঈদের মৌসুম হওয়ায় প্রতিদিনই তাদের মালামাল কিনতে হয়। এজন্য নগদ টাকা ব্যাংকে না রেখে দোকানেই রাখতেন। আগুনে মালামালের সঙ্গে অনেক ব্যবসায়ীর লাখ লাখ নগদ টাকাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে সরকারের কাছে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন ব্যবসায়ীরা।
বিষয়: #এখন লোনের টাকা শোধ করবো কেমনে’ #‘সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো