শিরোনাম:
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১
Swadeshvumi
মঙ্গলবার ● ২ মে ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » প্রতি বছর ৭ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে
প্রচ্ছদ » জাতীয় » প্রতি বছর ৭ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে
৩৫৩ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ২ মে ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

প্রতি বছর ৭ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে

---

# প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আগামী ৫০ বছরে আক্রান্তে হার বাড়বে পাঁচ গুণ

# থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সরকারিভাবে আইনি পদক্ষেপের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

শাহনাজ পারভীন এলিস

থ্যালাসেমিয়া জিনগত অর্থাৎ বংশানুক্রমিক রোগ। এই রোগ থ্যালাসেমিয়ার জিনবহনকারী দুই বাবা-মায়ের মাধ্যমে সন্তানের দেহে সংক্রমিত হয়। তবে সচেতনতার অভাব এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অপ্রতুলতার কারণে দুই থ্যালাসেমিয়া জিন বাহকের বিবাহ বন্ধ করতে না পারায় এই রোগ ক্রমেই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে বিস্তার লাভ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং দুই থ্যালাসেমিয়া জিন বাহকের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বন্ধ করতে না পারলে আগামীতে এই রোগ প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, বাবা-মায়ের একজনও যদি থ্যালাসেমিয়া জিনের বাহক না থাকে বা সুস্থ থাকে তাহলে তাদের পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে এই রোগ সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন চিকিৎসা বিষয়ক জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি অর্থাৎ কোটি ৮০ লাখের বেশি মানুষ থ্যালাসেমিয়া বাহক বা রোগী। এছাড়াও প্রতি বছর আরও হাজারের বেশি নতুন শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগের জিনসহ জন্মগ্রহণ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানের মাত্র ১০ ভাগ বাহককে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগামী ৫০ বছরে এই সংখ্যা ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে। দেশ জাতি হবে মেধাশূন্য, কমে যাবে মানুষের কর্মক্ষমতা

থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক পরিবারের পক্ষেই তা বহন করা সম্ভব হয় না। কারণ চিকিৎসায় রোগীকে প্রায় প্রতি মাসেই এক বা একাধিকবার রক্ত দিতে হয়। ২০১৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য শুধু রক্ত সঞ্চালনের জন্য তার পরিবারকে বছরে প্রায় দেড় থেকে লাখ টাকা খরচ করতে হয়। আরেক ধরনের চিকিৎসা হলো অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এই চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত মাত্র দুজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে।

চাঁদপুরের শফিকুল ইসলামের পুরো পরিবার থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও রোগী। ছবিতে তাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে থাকা দুই মেয়ে রোগী, দু’পাশে থাকা তাদের দুই ছেলে-মেয়ে বাহক

চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার নাওড়া গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম স্ত্রী মাহবুবা আনজু চার ছেলে-মেয়েসহ তার পুরো পরিবার থ্যালাসেমিয়া নামক জিনগত রোগের বাহক রোগী। তার বড় মেয়ে সানজিদা মিলি (২৪) এবং সায়মা ইসলাম (১২) এই রোগে আক্রান্ত। তবে তাদের অন্য দুই সন্তান সামিউল সামিয়া থ্যালাসেমিয়ার রোগের বাহক তাদের কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। চিকিৎসক জানিয়েছেন, শফিকুল আনজু উভয়েই  থ্যালাসেমিয়ার বাহক থাকায় তাদের সন্তানদের এই রোগের জীবাণু বংশানুক্রমিকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। শফিকুল জানিয়েছেন, রক্তস্বল্পতা রোগে ভোগা তার দুই মেয়ের চিকিৎসায় ওষুধসহ প্রতিমাসে তাকে খরচ করতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।

অন্যদিকে থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়েও যে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় তার উদাহরণও রয়েছে। বিষয়ে জানতে কথা হয় জয়পুরহাটের বিশ্ববিদ্যায় পড়ুয়া শিক্ষার্থী সাদিয়ার সাথে। তিনি জানান, তার বাবা থ্যালাসেমিয়ার বাহক থাকলেও মা ছিলেন সুস্থ। তাই জন্মগতভাবে সাদিয়া আর ছোটবোন সাবিহা এই জিনের বাহক। তবে তাদের শারীরিক কোন সমস্যা নেই, সুস্থ স্বাভাবিকভাবে চলছে তাদের জীবন। সাদিয়া এবার বগুড়ার সরকারি একটি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। তবে চিকিৎসক তাদের জানিয়েছেন ভবিষ্যেতে সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে হলে তাদের অবশ্যই একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক নন এমন ছেলে বিয়ে করতে হবে।

থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়েও সুস্থ জীবনযাপন করছেন   জয়পুরহাটের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী সাদিয়া ও তার বোন সাবিহা। তাদের বাবা থ্যালাসেমিয়ার বাহক থাকলেও মা সুস্থ

চিকিৎসক হিসেবে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে যারা দীর্ঘদিন ধরে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন তাদেরই একজন হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. টি এম আতিকুর রহমান। তিনি মুভমেন্ট ফর থ্যালাসেমিয়া ইরাডিকেশন ইন বাংলাদেশ (এমটিইবি) এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। এই রোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিনগত রোগ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তরা অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতাসহ নানা রকম জটিলতায় ভুগে থাকে। এই রোগের দুটি ধরন- একটি রোগাক্রান্ত এবং অন্যটি বাহক। পিতা-মাতার মধ্যে একজন যদি এই রোগের বাহক হন, তবে তাদের যে কোন সন্তান এই রোগের বাহক হতে পারে। তবে পিতা-মাতার উভয়েই যদি এই রোগের বাহক হন, তবে সন্তানদের মধ্যে এক বা একাধিকজন এই রোগের বাহক অথবা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আর থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের প্রায় প্রতি মাসেই এক বা একাধিকবার রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

ডা. আতিকুর জানান, ঘন ঘন রক্ত দেওয়ার ফলে আক্রান্ত রোগীদের বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা যায়। যেমন- রোগীর শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমতে থাকে। এতে অবসাদ অনুভব করা, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, ঘন ঘন সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি বৃদ্ধি, দুর্বলতা অনুভব করা, মুখের হাড়ের বিকৃতি, পেট বেশি বড় হয়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ অন্যান্য হরমোনজনিত সমস্যা দেখা যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বাচ্চাদের রক্তের চাহিদাও বেড়ে যায়। ফলে প্রতি মাসে রক্ত জোগাড় করতে রোগাক্রান্ত বাচ্চার পরিবারের আর্থিক মানসিক চাপের শিকার হতে হয়। কারণ রোগীর ধরন বুঝে চিকিৎসার জন্য ওষুধসহ প্রতি মাসে ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়।

ডা. আতিকুর আরও জানান, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হলো দুই থ্যালাসেমিয়া বাহকের বিবাহ বন্ধ করা। তাই এই রোগ নির্মূলেপ্রি-ম্যারিটাল থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং এবং আইডেন্টিফিকেশন অব থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার হলো একটি কার্যকর পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বাহক যাচাই সচেতনতা বৃদ্ধি করে, একজন বাহকের সঙ্গে অপর বাহকের বিয়ের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা এবং সমাজে এর ভয়াবহতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা জরুরি। তবে বাহকরা থ্যালাসেমিয়ামুক্ত মানুষকে বিয়ে করতে পারবেন। এই সমস্যা প্রতিরোধে সম্প্রতি তারা একটি সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছেন, যা (এমটিইবি) মুভমেন্ট ফর থ্যালাসেমিয়া নামে পরিচিত।

কিশোরগঞ্জের আলআমিন। স্ত্রীসহ তার পরিবারের সব সদস্যরা থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও রোগী

থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে জানতে বাহক শনাক্ত করতে www.roktimsahara.com  নামে একটি ওয়েবসাইট তারা তৈরি করেছেন। এর ওয়েবসাইটে গিয়ে তাদের নির্ধারিত কিছু তথ্য দিয়ে যে কোন ব্যক্তি (নারী-পুরুষ) তার রক্তে থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা জেনে নিতে পারবে। এবং একজন বাহক অপর বাহককে বিবাহ না ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে পারবেন। একই সাথে একজন থ্যালাসেমিয়া বাহককে যিনি এর বাহক নন অর্থাৎ সুস্থ ব্যক্তি; তিনি যেন অনীহা পোষণ না করেন এই ব্যাপারে অন্যদেরও উৎসাহ প্রদান করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

বিষয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বংশানুক্রমিক এই রোগ সম্পর্কে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনো জানে না বা সঠিক ধারণা নেই। ফলে অজ্ঞতা আর অসচেনতার কারণে তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রোগটি প্রবাহিত হয়ে তা দেশে সুস্থ, সবল জাতি গড়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ দুই বাহকের বিবাহ না হলেই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। তাই এর দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। জনসাধারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সচেতনতার দায়িত্ব সরকারের। তাই গণসচেতনতাই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের পূর্বশর্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে থ্যালাসোমিয়া বহনকারী ১০ শতাংশকে রোগহীন ৯০ শতাংশ জনসংখ্যা দিয়ে প্রতিরোধ করা যতটা সহজ; পরে এর বিস্তার বাড়লে অর্থাৎ বাহক/রোগাক্রান্তের সংখ্যা ৩০ অথবা ৫০ শতাংশ হলে তা মোকাবিলা করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। তাই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্রে থ্যালাসেমিয়া স্ট্যাটাস ব্লাড গ্রুপের মতো করে উল্লেখ করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। একই সাথে এই রোগ প্রতিরোধে দুই থ্যালাসেমিয়া বাহকের বিবাহ বন্ধ করতে হলে বিবাহ রেজিস্ট্রশনে এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্র যেমন বাধ্যতামূলক তেমনি থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করা জরুরি। তবে বিবাহ রেজিস্ট্রশনে থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করতে সরকারিভাবে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিলেন তারা।

উদাহরণ হিসেবে জানা গেছে, সাইপ্রাসে ১৯৭৫ সালে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে প্রিম্যারিটাল স্ক্রিনিং প্রসেস গ্রহণ করা হয়েছিল। আইন সঠিকভাবে প্রয়োগের ফলে সেই দেশে থ্যালাসেমিয়ার সংখ্যা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে প্রি-ম্যারিটাল থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং, বাধ্যতামলূক আইন চালু এবং বাস্তবায়ন করায় এছাড়া ইরান, গ্রিস, ইতালি পাকিস্তানসহ পৃথিবীর অনেক দেশে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।



বিষয়: #



আর্কাইভ