রবিবার ● ২৮ মে ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর পুরো জীবনই নাটকীয়তায় ভরা: ড. মাহফুজা হিলালী
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর পুরো জীবনই নাটকীয়তায় ভরা: ড. মাহফুজা হিলালী
যাত্রিক নাট্যগোষ্ঠীর `মহিয়সী নবাব ফয়জুন্নেছা’ নিয়ে নাট্যকারের সাথে আলাপচারিতা
শাহনাজ পারভীন এলিস
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গতকাল ২৭ মে প্রদর্শিত হয়েছে কুমিল্লার যাত্রিক নাট্যগোষ্ঠীর নাটক ‘মহিয়সী নবাব ফয়জুন্নেছা’। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন -এর আমন্ত্রণে শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্ট থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হয় নাটকটির তৃতীয় প্রদর্শনী। নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর জীবনকাহিনী নিয়ে গবেষণাধর্মী এই নাটকটি লিখেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহফুজা হিলালী। আর নির্দেশনা দিয়েছেন দেবাশীষ ঘোষ। এই নাটকের নানা দিক নিয়ে স্বদেশভূমির সাথে কথা বলেছেন নাট্যকার মাহফুজা হিলালী। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শাহনাজ পারভীন এলিস।
স্বদেশভূমি:কোন ভাবনা থেকে আপনি নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী নিয়ে আপনার নাটক লেখা?
ড. মাহফুজা হিলালী: নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে আমার কাছে বিস্ময়মানব মনে হয়। কারণ তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মহিলা নওয়াব ও নারীশিক্ষার পথিকৃৎ। তিনি বঙ্গীয় নারী প্রগতিরও পথিকৃৎ। অথচ এই মহান মানুষটি লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছেন। আমরা অনেকেই তার সম্পর্কে জানি না। আমি মনে করি তরুণ প্রজন্মের সবারই তাকে জানা প্রয়োজন। যদিও বই আকারে প্রকাশের সময় এই নাটকের নাম আমি দিই ‘ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী’।
স্বদেশভূমি: নাটক লেখার সময় নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর জীবনের কোন কোন বিষয়গুলোকে তুলে ধরেছেন?
ড. মাহফুজা হিলালী: ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীকে জানবার পর দেখেছিলাম তার পুরো জীবনই নাটকীয়তায় ভরা। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি আবিষ্কার করলাম, বাংলার প্রগতিশীল এই নারী সম্পর্কে এখনো অনেক জানার বাকি। আমিও ২০০৮ সালের আগে তাকে এতোটা জানতাম না। তাই তাকে নিয়ে লেখার আগ্রহ জন্ম নিলো। প্রথমে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখলাম। তারপর নির্দেশক দেবাশীষ ঘোষকে বললাম আমি একটি নাটক লিখবো তার ওপর। আপনি কি নির্দেশনা দেবেন? দেবাশীষ দা বললেন, জানাবেন। হঠাৎ একদিন ফোন করে বললেন কুমিল্লার ‘যাত্রিক নাট্যগোষ্ঠী’ ফয়জুন্নেছার ওপর নাটক করতে চায়, লিখে দাও। ইচ্ছা পূরণ হলো, নাটকটি লিখে ফেললাম।
স্বদেশভূমি: মঞ্চে নাটকটির উপস্থাপন এবং দেখার পর আপনার অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাই?
ড. মাহফুজা হিলালী: নাটকটি দেখবার সময় লক্ষ্য করলাম আমার চোখ দিয়েই পানি পরছে। কারণ ফয়জুন্নেছাকে যখন লিখেছি তখন বার বার আমি শিহরিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি, গর্বিত হয়েছি, আনন্দিত হয়েছি। আর মঞ্চে তাকে জীবন্ত দেখে চোখের অশ্রু ফেলেছি। সে অশ্রু একদিকে দুঃখের, অন্য দিকে আনন্দের। দুঃখের এই জন্য যে, একজন নারী ব্যক্তিজীবনে কতো দুখি! এখনও তো তা। এখনও অস্তিত্বশীল নারীরা কিছুই পায় না। কেবল নারীর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে। আর আনন্দ এ জন্য যে, সেই ১৮৩৪ থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত জীবনকালে একজন অস্তিত্বশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছিলেন!
স্বদেশভূমি: দর্শনার্থীদের অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাই?
ড. মাহফুজা হিলালী: কুমিল্লায় গিয়ে আমি নাটকের মঞ্চায়ন দেখেছি। ভারতের ত্রিপুরা থেকে ‘ত্রিপুরা থিয়েটার’-এর কয়েকজন এসেছিলেন। সবাই খুব প্রশংসা করেছেন। এই সময় একটা ঘটনা ঘটলো। তারা একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, ‘ত্রিপুরা থিয়েটার’ নামেই। বেশ বড়, মানসম্পন্ন থিয়েটার পত্রিকা। কলেবর আড়াইশ’ পৃষ্ঠার মতো। তো কয়েকটি কপি নিয়ে এসেছিলেন, কয়েকজন নির্ধারিত মানুষের জন্য। একজনকে বাদ দিয়ে এক কপি মঞ্চেই আমার হাতে তুলে দিলেন। এতে বোঝা গেলো নাটকটি তাদের মন ছুঁয়েছে। নাটক দেখার পর তাদের একজন বক্তৃতা দেয়ার সময় বলে গেলেন নাটকটি তারা ত্রিপুরায় নেবেন। এবং আমি যেন অবশ্যই সেখানে যাই। তাদের সেই স্বীকৃতি এবং ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ হয়েছি।
স্বদেশভূমি: নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর কর্মজীবনের কোন কোন দিকগুলো এই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে?
ড. মাহফুজা হিলালী: নাটকে ফয়জুন্নেছার বয়ানে এবং বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ফয়জুন্নেছার অবদানগুলো তুলে ধরা হয়েছে। ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী অত্যন্ত প্রজাদরদী এবং দানশীল মানুষ ছিলেন। তার জনহিতকর কাজের তালিকা দেখলে চমকে উঠতে হয়। নিজের পরগণার মানুষদের জন্য তিনি ১৪টি পুকুর এবং দীঘি খনন করেছিলেন। নির্মাণ করেছিলেন অনেক রাস্তা এবং সেতুসহ ২টি কবরস্থান। কয়েকটি আরোগ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত ‘জেনানা হাসপাতাল’এ চার হাজার মা ও শিশুর চিকিৎসা হয়েছিলো। শিক্ষা ক্ষেত্রেও তার অবদান অনস্বীকার্য। ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়, ১টি ইংরেজি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, পশ্চিম গাঁও-এ মধ্য ইংরেজি স্কুল, নিজ বাড়িতে একটি অবৈতনিক মাদ্রাসাসহ কয়েকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ের পাশে পুকুর এবং বাগানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
স্বদেশভূমি: ফয়জুন্নেসার অবদানগুলোকে নাটকে কীভাবে তুলে ধরেছেন?
ড. মাহফুজা হিলালী: জমিদারির বিভিন্ন স্থানে মসজিদ নির্মাণে দান করেছেন নওয়াব ফয়জুন্নেছা । নিজের বাড়িতে দশ গম্বুজ মসজিদ স্থাপন করেন। অন্য মসজিদের পাশেও পুকুর খনন করেছিলেন। নিজ বাড়িতে স্থাপন করেছিলেন মুসাফিরখানা। ১৮৯৯ সালে কুমিল্লা কলেজ স্থাপনেও তিনি কয়েক হাজার টাকা দান করেছিলেন। এছাড়া ত্রিপুরার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ডগলাস যখন সমাজকল্যাণমূলক একটি তহবিল গঠন করতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়েছিলেন, তখন ডগলাসের প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ অর্থ তিনি দান করেছিলেন। এই অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন এক লক্ষ টাকার সমমান। এছাড়া নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরেও তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
স্বদেশভূমি: ভারতবর্ষের বাইরে আর কোথায় কোথায় তার অবদান রয়েছে?
ড. মাহফুজা হিলালী: সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এই যে, ভারতবর্ষের বাইরে সুদূর মক্কায়ও তিনি সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন। ১৮৯৩ সালে হজ্বে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে বাংলাদেশ থেকে যারা হজ্ব করতে যান, তারা থাকা-খাওয়ায় অসুবিধায় পড়তেন। এই অসুবিধা দূর করার জন্য তিনি মক্কায় একটি মুসাফিরখানা এবং একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সেখানকার মাদ্রাসা-ই-সাওলাতিয় এবং ফুরকানিয়া মাদ্রাসার জন্য মাসিক তিনশ’ টাকা সাহায্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। জানা যায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার উত্তরাধিকাররা এ অর্থ নিয়মিত মক্কার মাদ্রাসা দুটিতে পাঠাতেন। এছাড়া সেখানে খলিফা পত্নী যোবায়দা বেগমের সহযোগিতা নিয়ে বহু টাকা ব্যয় করে একটি খালের পুনঃখনন করেন। তার আগে এবং পরে শত শত মানুষ হজ্জ্বে গিয়েছেন, কিন্তু তার মতো করে কেউ চিন্তা করেননি।
স্বদেশভূমি: ভাষা ও সংস্কৃতিতে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর অবদান সম্পর্কে কিছু বলুন?
ড. মাহফুজা হিলালী: ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী ছিলেন বহু ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত এবং উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি তার জমিদারির দাপ্তরিক ভাষা ফার্সির পরিবর্তে বাংলা করেছিলেন। একটি মুসলিম এবং উর্দুভাষী পরিবারের মেয়ে হয়েও তিনি বাংলা গান গাইতেন। বাংলায় কাহিনিকাব্য এবং দুটি গান লিখেছিলেন।
স্বদেশভূমি: নাটকে নবাব ফয়জুন্নেছা সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. মাহফুজা হিলালী: গণমাধ্যম পরিবারের নতুন সদস্য স্বদেশভূমি’র পরিবারের জন্য শুভকামনা।
বিষয়: #নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর পুরো জীবনই নাটকীয়তায় ভরা: