শুক্রবার ● ১ মার্চ ২০২৪
প্রচ্ছদ » অর্থনীতি » বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বীমা খাত একই সূত্রে গাঁথা
বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বীমা খাত একই সূত্রে গাঁথা
ফরিদুন্নাহার লাইলী এমপি
যুদ্ধ বিধস্ত দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরে আর্থিক খাতের প্রায় প্রতিটি সেক্টরে অভাবনীয় মহাযজ্ঞ শুরু করেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও বীমা খাতের অবদান রয়েছে। বীমা পেশার সুবাদে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের যে কাজ করে গেছেন তা সত্যিই অকল্পনীয়৷ প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার কারণে তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন একটি দেশের বীমা খাত যতো শক্তিশালী সে দেশের অর্থনীতিও ততো বেশি শক্তিশালী৷ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ভঙ্গুর অর্থনীতি বুভুক্ষমানুষের হাহাকার এবং ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশ পুর্নগঠনের পাশাপাশি তিনি বীমা শিল্পেও মনোযোগ দেন।
পাকিস্তান আমলের অর্থনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একটা সত্য স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান সরকার বেসরকারি খাতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান শক্তি বলে বিবেচনা করত। পূর্ববাংলার বেলায় এই কথাটি ছিলো আরও বেশি প্রযোজ্য৷ বাস্তবতা উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশ নং(৯৫) অনুযায়ী দেশের বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করেন৷ এর মাধ্যমে বীমা পেশার সকল কর্মচারীকে সরকারি চাকরির আওতায় আনা হয়৷ এই আদেশে দেশের ৭৫টি বীমা প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে ৫টি সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতপর ১৯৭৩ সালের ১৪ মে বীমা কর্পোরেশন অধ্যাদেশ ১৯৭৩ (Insurance Corporation Ordinance 1973) মাধ্যমে উক্ত পাঁচটি বীমা সংস্থাকে দুটি সংস্থার অধীনে আনা হয়। একটি হলো জীবন বীমা কর্পোরেশন এবং অন্যটি হলো সাধারণ বীমা কর্পোরেশন।
বঙ্গবন্ধু রাজনীতির পাশাপাশি জীবিকার জন্য বীমা পেশা বেছে নিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে কেন বঙ্গবন্ধু বীমা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন? ১৯৫৯ সালের ৭ আগস্ট প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান (EBDO) জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলো। সেই সময় ১৯৫৯ সালের ৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু জামিনে মুক্তি পান৷ শর্ত আরোপ করা হয় যে ঢাকার বাইরে গেলে তিনি স্থানীয় পুলিশকে অবহিত করবেন। মার্শাল ‘ল এড়িয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার পথ খুঁজতে থাকেন তিনি। অবশেষে ১৯৬০ সালের ১মার্চ তৎকালীন আলফা ইনস্যুরেন্সের বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও তিনি কৌশলগতভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির চাকা সচল রাখার স্বার্থে বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে বেছে নিয়েছিলেন বীমা পেশাকে। এই পেশার কার্যক্রম সংগঠন ভিত্তিক হওয়ার কারণে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। বীমা কোম্পানীর কাজের পাশাপাশি জনগনের অধিকার আদায় ও তাদেরকে সংঘবদ্ধ করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন তিনি। বিভিন্ন অঞ্চলে কোম্পানির কাজের জন্য ভ্রমনের আড়ালে তিনি নিরবে নিভৃতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সংহত ও বেগবান করে তোলেন৷ এর মাধ্যমে তিনি মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে মানুষকে সংগঠিত করেন এবং স্বাধীনতার চেতনাকে ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে জাগরুক করারও একটা সুযোগ পান। জাতীয় বীমা দিবস-২০২৩ উদ্বোধনকালে দেশরত্ন শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে বসেই ছয় দফা প্রণয়ন করেছিলেন। পুরো বিষয়টা টাইপ করেছিলেন মোহাম্মদ হানিফ (ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র)। পরে এটা একজন বিজ্ঞজন, তৎকালিন ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জালালু্িদ্দন সাহেবকে দিয়ে অনুবাদ করানো হয়। আমাদের যে স্বাধীনতা অর্জন বা ছয় দফা প্রণয়ন, ছয় দফার ভিত্তিতে ৭০ এর নির্বাচন-সবই কিন্তু ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে বসেই করা হয়। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্সের একটা যোগসূত্র রয়ে গেছে, এটাই বাস্তবতা। (ইনকিলাব ৩ মার্চ, ২০২৩)
বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ার কারনে তিনি যে শুধু মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই করে গেছেন তা নয়। সেবাধর্মী এই পেশার মাধ্যমে মানুষকে সঞ্চয়মুখী করার প্রয়াসে পুজি সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখার ব্যাপারেও অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছেন। নিজ দলীয় নেতা কর্মীদেরও এই বীমা পেশার সাথে সম্পৃক্ত করে কর্মসংস্থনের সুব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়াও তৎকালীন সময়কার বীমা ব্যক্তিত্ব খোদা বকশ, গোলাম মাওলা, গাজী গোলাম মোস্তফা, সামছুল আলম, নুরুল ইসলাম প্রমূখ ব্যক্তিবর্গসহ বীমা শিল্পের সকল স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে ছিল তার গভীর সম্পর্ক। তাই জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর আহবানে বীমা শিল্পের কর্মকর্তা কর্মচারীরা সবার আগে ঝাপিয়ে পড়তেন। এভাবেই বীমাকে তিনি রাজনীতি ও আন্দোলন সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। এই কথা দৃঢ় ভাবে বলা যায় বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের বীমা খাত একই সূত্রে গাঁথা হয়ে আছে৷
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বীমা খাতের উন্নয়নে দেশরত্ন শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সরকার গঠনের পর থেকে বীমা ব্যবস্থার উন্নয়নে ‘বীমা আইন-২০১০’ এবং ‘বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন-২০১০’ প্রণয়ন করেন। এর আওতায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। এই সংস্থার মাধ্যমে বীমা শিল্পের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যা ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে৷ সরকার ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন অ্যাক্ট-১৯৭৩ রহিত করে বীমা কর্পোরেশন আইন-২০১৯ এবং জাতীয় বীমা নীতি-২০১৪ প্রণয়ন করেছে। পাশাপাশি বীমা খাতে ‘একচুয়ারি’ নিয়োগের ব্যবস্থা করেছে।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত বীমা পেশা৷ ১মার্চ ১৯৬০ সালে তার বীমা পেশায় যোগদানের তারিখ৷ দিনটিকে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১লা মার্চকে জাতীয়-বীমা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন৷ যা বীমা শিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। এটা আমাদের বীমা খাতের সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য গর্বের। কেননা এই দিনে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির পাশাপাশি বীমা শিল্পে পেশাজীবনে জড়িত হয়েছিলেন। সুতরাং সংশ্লিষ্টরা বীমা খাতের সুশাসনের জন্য এই গভীর আবেগকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগুতে পারবে সহজেই। এজন্য আমরা গর্বিত, আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধু বড় অনুপ্রেরণা। যত দিন স্বাধীন দেশে লাল সবুজের পতাকা থাকবে তত দিন বাংলার মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার বীমার কর্মকাণ্ডের উজ্জল স্মৃতি।
লেখক: সংসদ সদস্য এবং কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
বিষয়: #বঙ্গবন্ধু #স্বাধীনতা ও বীমা খাত একই সূত্রে গাঁথা