শনিবার ● ২২ অক্টোবর ২০২২
প্রচ্ছদ » জাতীয় » জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
শুধু আবহমান বাংলার সৌন্দর্য আর প্রাণ-প্রকৃতি নয়, জীবনানন্দের শিল্পজগতে মূর্ত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও। সেখানে সমকালীন সমাজ বাস্তবতার কথাও বলে গেছেন কবি।
চিত্রকর্মের ক্যানভাসে নয়, গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ কাব্যে চিত্রায়িত করেছেন তিনি। আবহমান বাংলার চিত্ররূপ ও অনাবিল সৌন্দর্য যেন তার কাব্যগ্রন্থ ‘রূপসী বাংলা’র পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। তাই তো তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে হয়েছেন খ্যাত।
বাংলার প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি নিবিড় আচ্ছন্নতা তার। নিজেকেও বারবার দেখতে চেয়েছেন সেসব রূপে।
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে—এই বাংলায়,
হয়তো মানুষ নয়—হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।’
এই রূপসী বাংলার নদী-মাঠ-ক্ষেত ভালোবেসে বারবার বহুরূপে ফেরার বাসনায় যিনি ব্যাকুল ছিলেন, আজ তার চলে যাওয়ার ৬৮তম বার্ষিকী।
শুধু আবহমান বাংলার সৌন্দর্য আর প্রাণ-প্রকৃতি নয়, জীবনানন্দের শিল্পজগতে মূর্ত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও। সেখানে সমকালীন সমাজ বাস্তবতার কথাও বলে গেছেন কবি।
তিনি লিখেছেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।’
এমন দ্রোহের আখ্যান যার কাব্যে, তিনি বারবার ফিরে গেছেন রূপসী বাংলার কাছে। কার্তিকের ছায়া, হলুদ পাতায় শিশিরের শব্দ, বুনোহাঁস, শঙ্খচিল, পেঁচা, সোনালি ডানার চিল, নক্ষত্রের তারা জ্বলা রাত, শিরীষের ডাল, অশ্বত্থের চূড়া, কলমির ঘ্রাণ, হাঁসের পালক—এমনভাবে আবহমান বাংলাকে বহুমুখী উপমায় এঁকেছেন তার কাব্যে।
১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন জীবনানন্দ। বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহিণী, কিন্তু সংসারের কাজের ফাঁকেও লিখতেন কবিতা।
কুসুমকুমারী দাশের সবচেয়ে সুপরিচিত ‘আদর্শ ছেলে’ (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে)। কবিতাটি আজও শিশুশ্রেণির পাঠ্য।
মায়ের কাছ থেকেই সাহিত্যচর্চা ও কবিতা লেখার প্রেরণা পান জীবনানন্দ। বাবা কম বয়সে স্কুলে ভর্তির বিরোধী ছিলেন। এ কারণে বাড়িতে মায়ের কাছেই জীবনানন্দের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু।
১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে আট বছরের জীবনানন্দকে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে ১৯১৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯১৭ সালে ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম বিভাগে পাস করেন।
১৯১৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি এবং ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও তা আর শেষ করেননি তিনি।
পেশাগত জীবনে শিক্ষকতা করলেও স্থায়ী হননি কোথাও। অধ্যাপনা করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষকতার বাইরে জীবনের প্রয়োজনে তিনি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন।
অভাব-অনটন ছিল তার নিত্যসঙ্গী। জীবনের অধিকাংশ সময় গৃহশিক্ষকতা করে চালিয়েছেন সংসার।
১৯২৫ সালের জুনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তার স্মরণে ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ নামক একটি কবিতা লিখেন। এটি ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়।
পরবর্তী সময়ে ১৯২৭ সালে কবিতাটি ‘ঝরা পালক’ নামে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ হয়। ওই বছরেই সেই সময়ের নামী ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশ হয় ‘নীলিমা’ কবিতাটি। পরে কালি ও কলম, প্রগতিসহ কলকাতা, ঢাকা ও অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে।
১৯৩৬ সালে প্রকাশ হয় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। ১৯৪২ সালে ‘বনলতা সেন’, ১৯৪৪ সালে ‘মহাপৃথিবী’, ১৯৪৮ সালে ‘সাতটি তারার তিমির’ এবং ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রকাশ হয় ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’।
তার মৃত্যুর পর ১৯৫৭ সালে প্রকাশ হয় ‘রূপসী বাংলা’। ১৯৬১ সালে প্রকাশ হয় ‘বেলা অবেলা কালবেলা’।
জীবনানন্দ দাশ ‘রূপসী বাংলা’র পাণ্ডুলিপি তৈরি করলেও জীবদ্দশায় সেটি প্রকাশের উদ্যোগ নেননি।
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রাম দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন কবি। এ অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে, তবে চিকিৎসায় তেমন উন্নতি হয়নি।
অবস্থা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। অবশেষে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ২২ অক্টোবর রাতে না ফেরার দেশে চলে যান কবি।
বিষয়: #জীবনানন্দের রূপসী বাংলা