শুক্রবার ● ২৫ নভেম্বর ২০২২
প্রচ্ছদ » জাতীয় » আবারও নৌকায় ভোট দিন, হতাশ হবেন না: শেখ হাসিনা
আবারও নৌকায় ভোট দিন, হতাশ হবেন না: শেখ হাসিনা
যশোর থেকে শুরু হলো আ.লীগের নির্বাচনি প্রচারণা
বিশেষ প্রতিনিধি
‘বিগত দিনেও দেশের উন্নয়ন করেছি, আপনারা সুযোগ দিলে আগামী দিনেও উন্নয়ন করব। দেশকে এগিয়ে নিতে যা যা করা দরকার, আমাদের সরকার তা করবে। আমি আপনাদের দোয়া ও ভালোবাসা চাই। একই সঙ্গে আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই, আপনারা আগামী নির্বাচনে আবারও নৌকায় ভোট দিয়ে আমাদের জয়যুক্ত করবেন। আপনারা যা চাইবেন, আমি তার চেয়ে বেশি দেব।’
আগামী জাতীয় নির্বাচনের এক বছরেরও বেশি সময় বাকি থাকতেই ভোটের প্রচার শুরু করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান শহর যশোরে জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আবার নৌকায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানালেন। বলেছেন, ভোট দিলে তিনি প্রতিদান দেবেন। মানুষ যা চাইবে তার বেশিই দেবেন।
আওয়ামী লীগপ্রধান বলেন, ‘আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে আমাদের আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আমি আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই, আগামী নির্বাচনেও আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন।’
বৃহস্পতিবার বিকেলে যশোরের শামস-উল হুদা স্টেডিয়ামের এই জনসভায় গত জুনে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকার বাইরে শেখ হাসিনার প্রথম জমায়েত। ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর দ্বিতীয়বারের মতো তিনি ঢাকার বাইরে জনসভা করলেন।
আগামী বছরের শেষে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের কাছে আগামী নির্বাচনটি খুবই চ্যালেঞ্জের।
টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকার সময় নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ফুরফুরে মেজাজে থাকা ক্ষমতাসীন দলের কাছে বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এসেছে নতুন এক চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে সারা বিশ্বের মতো বিপাকে বাংলাদেশও। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ায় বিরোধীদের আক্রমণের মুখে সরকার।
এর মধ্যে বিএনপিও রাজপথে সক্রিয় হয়েছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে। দলীয় সরকারের অধীনে গত নির্বাচনে অংশ নিলেও পুরোনো দাবিতে ফিরে গিয়ে গত ৮ অক্টোবর থেকে প্রতি শনিবার বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ করছে তারা। সেসব জমায়েতে ব্যাপক উপস্থিতির মধ্যে এই সমাবেশটি আওয়ামী লীগের কাছে ছিল জনসমর্থন প্রমাণের চ্যালেঞ্জ।
সকাল থেকেই সমাবেশস্থলে মিছিল নিয়ে আসতে থাকেন নেতা-কর্মীরা। জেলার আট উপজেলাসহ আশপাশের জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকেও এসেছে তারা।
প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সাদা গেঞ্জি ও লাল-সবুজ টুপি পরে পুরুষ কর্মী-সমর্থকরা এবং লাল পাড়ের সবুজ শাড়ি পরে নারী কর্মী-সমর্থকরা এসব মিছিলে আছেন।
সকাল থেকে যশোর শহরের বিভিন্ন সড়কে এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। যশোরের গদখালি থেকে আসা আব্দুল মান্নান জানান, তার এলাকা থেকে ৫ হাজার লোকের একটি মিছিল চাচড়া থেকে হেঁটে জনসভায় এসেছে।
একপর্যায়ে গোটা স্টেডিয়াম লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। মানুষের ভিড় গিয়ে ঠেকে আশেপাশের বিভিন্ন সড়কে।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো তুলে ধরে আগামীতে দক্ষিণাঞ্চলে আরও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। বলেন, ‘বিগত দিনেও দেশের উন্নয়ন করেছি, আপনারা সুযোগ দিলে আগামী দিনেও উন্নয়ন করব। দেশকে এগিয়ে নিতে যা যা করা দরকার, আমাদের সরকার তা করবে। আমি আপনাদের দোয়া ও ভালোবাসা চাই। একইসঙ্গে আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই, আপনারা আগামী নির্বাচনে আবারও নৌকায় ভোট দিয়ে আমাদের জয়যুক্ত করবেন। আপনারা যা চাইবেন, আমি তার চেয়ে বেশি দেবো।’
শেখ হাসিনা এই জনসভায় তার সরকারের আমলের উন্নয়ন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নানা দেশের মতো বাংলাদেশেরও সংকট তৈরি হওয়া, বিএনপি শাসনামলের পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। তবে তিনি বিএনপির নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবির বিষয়টি তার ভাষণে ছিল পুরোপুরি অনুপস্থিত।
‘রিজার্ভে কোনো সমস্যা নেই’
ইউক্রেন যুদ্ধজনিত কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের রিজার্ভেও টান পড়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখনও যে রিজার্ভ আছে, তা যথেষ্ট। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ নিয়ে কান না দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেকেই রিজার্ভ নিয়ে কথা বলেন। রিজার্ভের কোনো সমস্যা নাই। অনেকে বলেন, ব্যাংকে টাকা নাই, ব্যাংক থেকে টাকা তোলেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখলে তো চোরে নিয়ে যাবে। চোরের জন্য সুযোগ করে দেয়া। ব্যাংকে টাকা নেই কথাটি ঠিক না। গতকালও আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিটিং করেছি। প্রত্যেকটি ব্যাংকে যথেষ্ট টাকা আছে। আমদের রেমিট্যান্স আসছে, বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের ট্যাক্স কালেকশন বৃদ্ধি পেয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উন্নত দেশও করোনা ভ্যাকসিন বিনা পয়সায় দেয়নি। কিন্তু আমরা ভ্যাকসিন কিনে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দিয়েছি। এ জন্য রিজার্ভ থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছি। অনেকে আমাদের রিজার্ভ নিয়ে কথা বলে যে রিজার্ভ গেল কোথায়। রিজার্ভ কোথাও যায়নি। মানুষের কাজে লেগেছে।’
সারাবিশ্বে দ্রব্যমল্যে ঊর্ধ্বগতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে গম দুই শ ডলারে কিনতাম তা এখন ছয় শ ডলার। তারপরও আমরা কিনে এনেছি আমাদের দেশের মানুষের জন্য।
‘গম, ভুট্টা, সার, প্রত্যেকটি জিনিসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে, পরিবহন খরচ বেড়েছে। তারপরও আমরা কিনে এনেছি যাতে খাদ্য ঘাটতি না দেখা দেয়। এজন্য আমি জমি অনাবাদী না রেখে উৎপাদন করার কথা বলেছি।’
‘গুজবে কান দেবেন না’
বিএনপির গুজব ছড়াচ্ছে অভিযোগ করে এতে কান না দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান সরকারপ্রধান। বলেন, ‘গুজবে কোনো কান দেবে না। বিএনপি কাজই হচ্ছে গুজব ছড়ানো। ওরা নিজেরা তো কিছু করতে পারে না। ক্ষমতায় এসে শুধু লুটপাট করে খেয়েছে।’
‘জিয়া যখন মারা যায় কোনো কিছু রেখে যায়নি ভাঙা সুটকেস আর ছেড়া গেঞ্জি ছাড়া। কিন্তু সেই ভাঙা সুটকেস হয়ে গেরো জাদুর বাক্স। যেই বাক্স দিয়ে কোকো-আর তারেক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আর পাচার করেছে বলেই তার শাস্তি হয়েছে।
‘তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত আসামি। বাংলাদেশের অর্থ বিদেশে পাচার করার মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে তার ৭ বছরের জেল আর ২০ কোটি টাকা জরিমানা হয়েছে। …অস্ত্র চোরকারবারি করতে গিয়ে দশ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে ধরা খেয়েছে। সেখানেও তার সাজা হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করতে গিয়ে আমাকেসহ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী হত্যা করতে চেয়েছিল। সেই মামলায় সে সাজাপ্রাপ্ত।
‘আর খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে দিয়ে সাজাপ্রাপ্ত। আর সাজাপ্রাপ্ত যে দলের নেতা সে জনগণকে কী দেবে? তারা কিছুই দিতে পারে না শুধু মানুষের রক্ত চুষে খেতে পারে। এটাই হলো বাস্তবতা।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। আর বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় থাকতে কী দিয়েছে? দিয়েছে অস্ত্র, দিয়েছে খুন, দিয়েছে হত্যা। এই যশোরে শামসুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে, মুকুলকে হত্যা করা হয়েছে। খুলনায় মঞ্জুরুল ইমাম, মানিক সাহা, বাবুসহ বহু সাংবাদিকদের একে একে হত্যা করা হয়েছে। শুধু রক্ত আর হত্যা ছাড়া বিএনপি তো আর কিছুই দিতে পারেনি দেশের মানুষকে। আর নিজেরো লুটপাট করেছে। নিজেরা মানুষের অর্থ পাচার করেছে, মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, নিজেদের উন্নয়ন করেছে।’
যশোরে উন্নয়নের ফিরিস্তি
যশোরে বিএনপি সরকার কোনো উন্নয়ন করেনি দাবি করে আওয়ামী লীগের আমলে সেখানে সরকার কী কী করেছে, তা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
এই অঞ্চলে নাড়ির টান আছে জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘এখানের মাটিতে আমার নানা শেখ জহুরুল হক শুয়ে আছেন। তিনি যশোরে চাকরি করতেন। আমার মায়ের বয়স যখন তিন বছর ছিল তখন তিনি মারা যান। ওই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই খারাপ ছিল, এর কারণে এখানে পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ আসতে পারেনি। সে কারণে নানাকে এখানে দাফন করা হয়।’
নানার নামে যশোরে আইটি পার্ক করার প্রতিশ্রুতিও দেন সরকারপ্রধান। শামস-উল হুদা স্টেডিয়াম আধুনিকীকরণে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য একটি প্রকল্প শেষ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এবার আমরা দ্বিতীয় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এর ফলে যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা দূর হবে।
‘৮২ কিলোমিটার নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে কাজ হাতে নিয়েছি। কপোতাক্ষের মতো ভবদহের জলাবদ্ধতা না থাকে সেই বিষয়েও আমরা পদক্ষেপ নেব।’
ভাঙা-যশোর-বেনাপোল, খুলনা-যশোর-কুষ্টিয়া, যশোর-খুলনা-মংলা-রাস্তাগুলো সব জাতীয় সড়কে উন্নীত করে দেয়া হচ্ছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘পদ্মা সেতু থেকে যাতে যশোরে সরাসরি আসতে পারে। ভাঙা-যশোর রাস্তাও মহাসড়কে উন্নীত হবে। ঢাকা থেকে যশোর রেল সংযোগের কাজের কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।’
তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে যশোরে একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাঁচ শ শয্যার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নির্মানের প্রাথমিক কাজ এখন চলমান আছে। প্রত্যেকটি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ বেডের ছিল। আমরা তা ৫০ বেডে উন্নীত করে দিয়েছি।
‘যশোরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়েছি। যশোর বিমানবন্দরকে আরও আধুনিকায়ন এবং যশোর-চট্টগ্রাম নতুন রুট চালু করা হবে। প্রত্যেকটি উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম করে দিচ্ছি।’ এসময় অভয়নগরে একটি ইপিজেড করার ঘোষণাও দেন শেখ হাসিনা।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারর।
বক্তব্য দেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পীযুষ ভট্টাচার্য, আবদুর রহমান, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, এস এম কামাল হোসেন, মির্জা আজম, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় সদস্য আমিরুল আলম মিলন, ইকবাল হোসেন অপু, পারভীন জামান কল্পনা, গ্লোরিয়া সরকার ঝর্ণা।
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দিন খান, নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন খান নিলু, সংসদ সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময়, শেখ আফিল উদ্দিন, কাজী নাবিল আহমেদ, নাসির উদ্দিন, যুবলীগের চেযারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার, সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যও এতে বক্তব্য রাখেন।
বিষয়: #আবারও নৌকায় ভোট দিন #হতাশ হবেন না: শেখ হাসিনা