শিরোনাম:
ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১
Swadeshvumi
বৃহস্পতিবার ● ১৯ জানুয়ারী ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » মরণোত্তর দান করা কিডনির সফল প্রতিস্থাপন
প্রচ্ছদ » জাতীয় » মরণোত্তর দান করা কিডনির সফল প্রতিস্থাপন
২৮১ বার পঠিত
বৃহস্পতিবার ● ১৯ জানুয়ারী ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

মরণোত্তর দান করা কিডনির সফল প্রতিস্থাপন

---
* দেশে মরণোত্তর দান করা কিডনির এটিই সফল অস্ত্রোপচার
* সারা ইসলামের নাম দেশের চিকিৎসাশাস্ত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে: ডা. শারফুদ্দিন

শাহনাজ পারভীন এলিস

মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি আলাদা দুই ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৪টা পর্যন্ত দুটি কিডনির একটি প্রতিস্থাপন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর অন্যটি প্রতিস্থাপন করা হয় কিডনি ফাউন্ডেশনে। সারাহ ইসলাম (২০) নামের এক তরুণীর দান করা কিডনি দুই নারীর দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। মৃত্যুর আগে ওই তরুণী কর্নিয়াও দান করেন।
দেশে প্রথমবারের মতো কিডনি প্রতিস্থাপনের এমন অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেন বিএসএমএমইউর রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকার বাসিন্দা সারা ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে মস্তিষ্কে টিউমারসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তার শিক্ষক মা বলেন, সারা মৃত্যুর আগে তার দেহের সবকিছুই দান করে দিতে বলেছেন। তবে তার শরীর থেকে শুধু কিডনি ও কর্নিয়া নেওয়া হয়েছে। সারাকে বীরের মর্যাদা দেওয়া উচিত। মরণোত্তর কিডনি দানে উদ্বুদ্ধ করতে সারার এই দান মানুষের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে।

---
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, তিন দিন আগে সারা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বিএসএমএমইউতে ভর্তি হন। গত বুধবার সন্ধ্যায় তাকে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণা দেওয়া হয়। হাবিবুর রহমান জানান, তার কিডনির সঙ্গে ম্যাচ করতে কয়েকজন কিডনি রোগীর তথ্য মেলানো হয়। এর মধ্যে ৩৪ ও ৩৭ বছর বয়সী দুই নারীর সঙ্গে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মিলে যায়। আত্মীয় না হওয়ায় এর বেশি মেলেনি। বাকিটা ওষুধ প্রয়োগে উপযোগী করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিকেলে বিএসএমএমইতে সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, মরণোত্তর কিডনিসহ অঙ্গ দানের জন্য সারা ইসলামের নাম এদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর তার দান করা অঙ্গের সফল প্রতিস্থাপন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের তালিকায় আরো এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।
উপাচার্য আরও বলেন, এর আগে আমরা এ ধরনের দুই একটি রোগীর ক্ষেত্রে সফল হতে গিয়েও অঙ্গদানে রাজি করাতে পারিনি। কিন্তু আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা সফল হয়েছি। বাংলাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছি। ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রথম অঙ্গদাতা সারা ইসলামের নাম বাংলাদেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার এই মহৎ আত্মত্যাগের মহিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভাস্মর হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে সবার মাঝে সচেতনতা তৈরি হবে এবং যাদের প্রয়োজন এমন সব রোগী অঙ্গগ্রহণের মাধ্যমে নতুন জীবন পাবে।

মা শবনম সুলতানার সঙ্গে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রথম অঙ্গদাতা সারা ইসলাম

এদিকে সারাহ-এর মা শবনম সুলতানার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ মুহূর্তে কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা তার নেই। গতকাল জোহরের নামাজের পর আজিমপুর কবরস্থানে সারাহকে দাফন করা হয়।
দেশে কত কিডনি রোগী আছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। তবে ২০২০ সালে করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অন স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস  রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে সব ধরনের মৃত্যুর মধ্যে কিডনি জটিলতায় মৃত্যুর স্থান ৮ নম্বরে। কিডনি জটিলতায় ৩ শতাংশের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। জীবিত ব্যক্তির দানে কত কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়, সে তথ্যও নেই। বিএসএমএমইউতে প্রতি সপ্তাহে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।

কেমন ছিলো কিডনি প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়া
বিএসএমএমইউর রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুর রহমানের নেতৃত্ব অস্ত্রোপচার দলে ছিলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক তৌহিদ মো. সাইফুল হোসাইন, সহযোগী অধ্যাপক ফারুক হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক কার্তিক চন্দ্র ঘোষসহ ১৫ চিকিৎসক। তারা জানান, গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে দাতার কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অস্ত্রোপচারে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। এরপর কিডনিটিকে প্রতিস্থাপনযোগ্য করতে আধা ঘণ্টা লাগে। কিডনি প্রতিস্থাপনে সময় লাগে আরও দুই ঘণ্টা।

---
কিডনি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের অধ্যাপক এ কে এম খুরশিদুল আলমের নেতৃত্বে ৩৭ বছর বয়সী নারীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। মৃত ব্যক্তি বলতে এখানে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ‘ব্রেন ডেথ’ অনেক রোগী থাকেন। তারা আর বাঁচেন না। তাদের হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস ফ্লুইডের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিছুদিন চালু রাখা যায়।
কোন ব্যক্তি ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত হওয়ার পর কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ বা লিভার, অগ্ন্যাশয় (প্যানক্রিয়াস) ও খাদ্যনালির মতো অঙ্গগুলো দান করলে অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। তবে হৃৎপিণ্ড থেমে গেলেও কর্নিয়া, অস্থি, অস্থিমজ্জা ও চর্ম প্রতিস্থাপন করা যায়। এগুলোকে ক্যাডাভেরিক প্রতিস্থাপন বলা হয়। এমন ব্যক্তিদের কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে দিকনির্দেশনা, তদারকি ও পরামর্শ দেওয়ার কাজ করে ক্যাডাভেরিক জাতীয় কমিটি।
---
কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি পর্ব
২০১৯ সাল থেকে মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয় বিএসএমএমইউ। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন লজিস্টিক সহায়তাসহ প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রিফ কাউন্সিলর (শোকার্ত মানুষকে মানসিক সহায়তাদানকারী) গঠন, অন্য হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি ইত্যাদি কাজ শুরু করা হয়।
বিএসএমএমইউ দীর্ঘ প্রস্তুতির পর গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো মরণোত্তর দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। জরুরি ভিত্তিতে কিডনি প্রয়োজন-এমন ৫০ রোগীর তালিকা করে বিএসএমএমইউ। এর মধ্যে অন্তত তিনবার মৃত ব্যক্তির কিডনি পাওয়ার আগমুহূর্তে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের অনীহায় প্রতিস্থাপন করা হয়নি। বিএসএমএমইউর উপাচার্য ও ক্যাডাভেরিক জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান শারফুদ্দিন আহমেদ গত ডিসেম্বরে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আমরা মরণোত্তর দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ প্রথমবারের মতো শুরু করতে চাই। এ জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
মরণোত্তর দানের কিডনি প্রতিস্থাপনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএসএমএমইউ। এজন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল এবং বিএসএমএমইউর আইসিইউর সঙ্গে বিএসএমএমইউ চুক্তি করেছে। সেখানে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত আইসিইউর রোগীদের পরিবার সম্মতি দিলে কিডনি নেওয়া হবে।

ছয় মাস ধরে বেশ কয়েকবার এমন কিডনি পাওয়ার ব্যবস্থা হলেও তা সংগ্রহ করা যায়নি। এক রোগী ছিলেন বিএসএমএমইউর আইসিইউতে। ওই রোগীর পরিবার কিডনি দান করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু আইসিইউ থেকে ওই রোগীর টিউব খুলে ফেলা হয়। এ কারণে আইসিইউ ব্যবস্থাপনায় থাকা ব্যক্তিদের ভুলে শেষ মুহূর্তে সংগ্রহ করা যায়নি। একই ঘটনা ঘটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরেক রোগীর ক্ষেত্রে। বছরখানেক আগে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে এক রোগী ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত হলে পরিবার কিডনি দিতে সম্মত হয়। তবে ভোরবেলা রোগীর মৃত্যু হলে পরিবারটি মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যায়।

---
জাতীয় ক্যাডাভেরিক কমিটির অংশ হিসেবে কাজ করে বিএসএমএমইউর ক্যাডাভেরিক সেল। ওই সেলের প্রধান বিএসএমএমইউর প্রক্টর ও ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ব্রেন ডেথ’ ব্যক্তির কিডনি ছয় ঘণ্টা সংরক্ষণ করা যায়। মরণোত্তর কিডনি দানকে কর্নিয়া দানের মতো সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। যাদের কিডনি পাওয়ার কোন উৎস নেই এবং যাদের দ্রুত প্রয়োজন, তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে তালিকা করা হয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপনে বিএসএমএমইউর করা ৫০ রোগীর তালিকায় থাকা এক নারী রোগী গণমাধ্যমকে বলেন, তার সমস্যা আগের চেয়ে জটিল হওয়ায় ডায়ালাইসিস শুরু করেছেন। প্রতিস্থাপনযোগ্য কিডনির অপেক্ষায় আছেন।
বিএসএমএমইউ’র নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম গত ডিসেম্বরে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ভারতেও সাত থেকে আট বছর আগে মরণোত্তর কিডনি দান শুরু হয়েছে। কিডনি সংগ্রহের পর তা দ্রুত প্রতিস্থাপন করতে হবে। উন্নত দেশগুলো ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কিডনি সংরক্ষণ করতে পারে। আমাদের এখনো ততটা ভালো ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনায় ‘ব্রেন ডেথ’ রোগীদের কিডনি সবচেয়ে সুস্থ থাকে। তাই তাদের কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৮ অনুয়ায়ী জীবন রক্ষায় নিকটাত্মীয়ের কিডনি নেওয়া যাবে। নিকটাত্মীয়ের মধ্যে রয়েছে- মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এবং আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা-নানি, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন। তবে আইনের ফাঁক গলিয়ে অবৈধভাবে দেশে কিডনি কেনাবেচা হচ্ছে। বর্তমানে একটি কিডনি কিনতে খরচ হচ্ছে ন্যূনতম সাত লাখ টাকা। মাঝেমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি কেনাবেচার চক্রের সক্রিয়তা চোখে পড়ছে। এমন চক্রগুলো একেকটি কিডনির জন্য ২০ লাখ টাকাও নিয়ে থাকে। অনেকে আবার কিডনিদাতাকে দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।



বিষয়: #



আর্কাইভ