বুধবার ● ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » খেজুরের রস, বাদুড় ও শূকর থেকে দূরে থাকুন: ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ
খেজুরের রস, বাদুড় ও শূকর থেকে দূরে থাকুন: ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ
নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে- ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ
এবছর নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ৮
তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের
মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ
শাহনাজ পারভীন এলিস
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার আওতাপারা এলাকার সানোয়ার হোসেনের সাত বছরের ছেলে সোয়াদ হোসেন। ছোট্ট এই শিশুটি সম্প্রতি প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তার পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, শিশুটি গত ২০ জানুয়ারি খেজুরের রস খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। অবস্থার অবনতি হলে পরদিন তাকে প্রথমে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৩ জানুয়ারি সোমবার ভোওে সেখানেই শিশুটি মারা যায়।
এ ঘটনায় রোগীর নমুনা পরীক্ষা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় শিশুটি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলো। তবে ওই শিশুর পরিবারের আর কাউকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত নয়। এ ঘটনা তদন্ত করছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ১৭ সদস্যের তদন্ত দল। এটি পাবনায় নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর প্রথম ঘটনা।
এর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে খেজুরের কাঁচা রস পানে ফরিদপুরে এক নারী ও তার পাঁচ বছরের কম বয়সী কন্যা নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়। পরবর্তীতে শিশুটির মৃত্যু হয় এবং ওই নারী গুরুতর স্নায়বিক জটিলতার শিকার হন। জাতীয় নিপাহ সার্ভেইল্যান্স কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরের বছরের আগস্টে তিনি একটি সুস্থ ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। নিয়মিত চিকিৎসার অংশ হিসেবে নবজাতকের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। মায়ের কাছ থেকে শিশুর সংক্রমণের (ভার্টিকেল ট্রান্সমিশন) সম্ভাবনা বাদ দেওয়ার জন্য সেই নমুনা রেফারেন্স ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়েছিল। র্যাপিড ও পিসিআর টেস্টে নিপাহ সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। তবে অ্যান্টি-নিপাহ আইজিজি-এর একটি উচ্চ টাইটার দেখতে পাওয়া যায়।
এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেয়া চিকিৎসক আইসিডিডিআরবি’র সংক্রামক রোগ বিভাগের সমন্বিত সংক্রমণ শাখার সহকারী বিজ্ঞানী এবং প্রকল্প উপসমন্বয়ক ড. সৈয়দ মইনুদ্দীন সাত্তার বলেছেন, ‘গবেষণায় প্রথম নিপাহ ভাইরাসভিত্তিক ইমিউন প্রপার্টিজের ভার্টিকেল ট্রান্সফার বা মা থেকে শিশুতে পরিবাহিত হওয়ার প্রমাণ নিশ্চিত করে। ভাইরাস নিউট্রিলাইজেশনের কার্যকারিতা এবং নবজাতকের সুরক্ষার সম্ভাব্যতার বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।’
নিপাহ ভাইরাস প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ সংবাদ সারাবেলাকে জানিয়েছেন, ‘সম্প্রতি মানুষের মধ্যে আবারও খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করছি। এটি কী ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে তা না জেনেই মানুষ এই রস খাচ্ছে। আমরা সবাইকে খেজুরের কাঁচা রস খেতে নিষেধ করছি। কারণ রস সংগ্রহের সময় যত সতর্কতাই অবলম্বন করা হয়ে থাকুক না কেন, এটি অনিরাপদ।’
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ জানান, নিপাহ ভাইরাস হলো জুনোটিক ভাইরাস বা এক ধরনের আরএনএ ভাইরাস; যা এই রোগে সংক্রমিত পশু বা মানুষ থেকে থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়। এটি দূষিত খাদ্যের মাধ্যমে অথবা সরাসরি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। টেরোপাস জেনাসের ফলখেকো বাদুড় এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক ধারক। নিপা ভাইরাস ফল খাওয়া বাদুড়দের থেকে অন্যান্য প্রাণী ও মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে।
এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে ডা. আব্দুল্লাহ জানান, জ্বর, মাথাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, বমি, কাশি, গলা ব্যথা বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো উপসর্গ দেখা যায়। মাথা ঘোরা, তৃষ্ণা, বেঁহুশ হয়ে যাওয়া, অসংলগ্ন কথা এবং মস্তিষ্কের তীব্র সংক্রমণজনিত স্নায়ুবিক লক্ষণ রয়েছে। কিছু লোক নিউমোনিয়া, তীব্র বুক যন্ত্রণাসহ তীব্র শ্বাসকষ্টের সম্মুখীন হয়েও থাকেন। এমনকি কোন রোগী ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অচেতনাবস্থায়ও চলে যেতে পারেন। অল্পসংখ্যক মানুষ যারা প্রাথমিকভাবে ভালো হয়ে উঠলেও পরবর্তীকালে মস্তিষ্কের সংক্রমণে খিঁচুনির মতো জটিলতা ভুগতে পারেন। নিপাহ ভাইরাসের উপসর্গ থাকলে রোগীর নমুনা ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়। রোগ নির্ণয়ে সাধারণত প্রস্রাব, রক্ত, সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষার পাশাপাশি এলাইসা, কোষ কালচার দ্বারা ভাইরাসটিকে শনাক্ত করা যায়।
প্রতিরোধ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাদুড় ও রুগ্ন শূকর থেকে দূরে থাকতে হবে এবং অপরিশুদ্ধ খেজুর রস খাওয়া হতে বিরত থাকলে এই রোগ সংক্রমণের হতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে তার ব্যবহৃত বিছানাসহ পোশাক পরিষ্কার করার সময় মুখে মাক্স ও হাতে গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে। কফ্-কাশি গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। খেজুরের রস সংগ্রহে হাঁড়ি পাতার সময়ে হাড়িটির মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে তার ওপর ডাকনা দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। যাতে বাদুড় বা পাখি বসে মলমূত্র ফেলতে না পারে।
ডা. আব্দুল্লাহ জানান, ২০১৮ সালে ভারতের কেরালা রাজ্যে এই রোগের আক্রমণে কমপক্ষে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ এবং ভারতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব সংক্রমিত ফলভোজী বাদুড়ের প্রস্রাব অথবা লালা দ্বারা দূষিত ফল বা ফলের পণ্য (কাঁচা খেজুর রস) খাওয়ার ফলে ঘটে। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেক সংক্রমণ রোগীদের সেবাযত্নকারীর মাধ্যমেই এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে ছড়ায়।
গত ২৯ জানুয়ারি রোববার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘নিপাহ ভাইরাসের কোন ওষুধ নেই, ভ্যাকসিনও নেই। তাই এটাতে সিম্পটোম্যাটিক ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়, যেভাবে করোনার চিকিৎসা আমরা দিয়ে আসছিলাম। যেহেতু এখনো এই ভাইরাসের প্রতিষেধক কোন টিকা আবিষ্কৃত হয়নি, তাই আমাদের সজাগ থাকতে হবে।’ তিনি আরও জানান, নিপাহ ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে অনিরাপদ খেজুরের কাঁচা রস পান করা যাবে না এবং পাখির খাওয়া ফল খাওয়া যাবে না।
জানা গেছে, ভাইরাসটির নাম মালয়েশিয়ার সুঙ্গাই নিপাহ গ্রাম থেকে এসেছে। কারণ ১৯৯৮ সালে সেখানে ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত করা হয়। মালয়েশিয়ার সুঙ্গাই নিপাহ নামক একটি গ্রামে শূকর ও তার চাষীদের মধ্যে প্রথম এই ভাইরাস সনাক্ত হয়। পরের বছর দেশটিতে ১০৫ প্রাণির মৃত্যুসহ ২৫৬ জন মানুষের মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটে। সংক্রমণ রোধে সেসময় দেশটিতে লাখ লাখ শূকর মেরে ফেলা হয়। ১৯৯৯ সালে নিপাহ ভাইরাস সিঙ্গাপুরেও শনাক্ত হয়। দেশটিতে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু ও ১১ জনের মস্তিষ্কে সংক্রমণ বা শ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দেয়।
বাংলাদেশে ২০০১ সালে প্রথম নিপাহ শনাক্ত হয় মেহেরপুরে। ওই বছরই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিলিগুড়িতে এই ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে বাংলাদেশের নওগাঁ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় এই রোগের প্রকোপ ঘটে। এরপর থেকে প্রতি বছরই কোন না কোন জেলায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ৩৩১ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছে ২৩৬ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নিপাহ ভাইরাসে গোটা বিশে^ মৃত্যুর হার প্রায় ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পরও গুরুতর স্নায়ুবিক জটিলতার শঙ্কা রয়েছে। গর্ভবতী নারীদের গর্ভাবস্থার শেষের দিকে এ জটিলতা আরও খারাপ হতে পারে। চলতি বছর বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৮ জন। আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। এই ভাইরাসে গড় মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ।
বিষয়: #নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ: ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ