শুক্রবার ● ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে পরিকল্পিত নগরায়নের বিকল্প নেই
ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে পরিকল্পিত নগরায়নের বিকল্প নেই
# বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ ২০ শহরের মধ্যে ঢাকা
# ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় দরকার পরিকল্পিত নগরায়ন
শাহনাজ পারভীন এলিস
ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ বিপর্যয় এবং হতাহতের ঘটনা নাড়া দিয়েছে গোটা বিশ^কে। ভূমিকম্পের শঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশেও। এক্ষেত্রে বিশে^র ভূমিকম্পপ্রবণ ২০টি শহরের মধ্যে আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকাও রয়েছে। কিন্তু এই শঙ্কা মোকাবিলা এবং যদি বিপর্যয় ঘটে তার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা ও প্রস্তুতি এখনো পর্যাপ্ত নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঘনবসতিপূর্ণ নগরী ঢাকায় যে পরিমাণ বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে তাতে মাত্র ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই- মুহূর্তে ধসে পড়বে এসব ভবন, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যাহত হবে উদ্ধার কাজ।
অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সক্ষমতা অর্জন করলেও ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান। স্বদেশভূমিকে তিনি বলেছেন, ‘পরিকল্পিত নগরায়ন এদেশে ভূমিকম্প মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব নয়। এছাড়া সুউচ্চ ভবনের পাশাপাশি মাটির নিচ দিয়ে নেওয়া বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ভূমিকম্পের পর এগুলো থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। অপরিকল্পিত ভবন ও সরু রাস্তাগুলোর কারণে ফায়ার সার্ভিস এবং স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য উদ্ধার তৎপরতা চালানোও কঠিন হবে। তাছাড়া ভূমিকম্পের সময় খোলা জায়গা না থাকা, মাঠ বা উদ্যান না থাকার কারণে ভবন ছেড়ে বের হয়েও দুর্ঘটনার হুমকিতে থাকবেন মানুষ। ’
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ গবেষক মমিনুল ইসলাম বলেছেন, ‘প্লেট টেকটনিক্স অবস্থানের মধ্যে ইউরেশিয়ান, বার্মা মাইক্রেপ্লেট ও ইন্ডিয়ান- এই তিন প্লেট বাউন্ডারির সংযোগস্থল ও কাছাকাছি অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এ কারণে আমরা বড় ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছি। এ জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া শহরে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে মাটির নিচে থাকা গ্যাস ও বৈদ্যুতিক লাইনগুলোকে অটো শাটডাউন করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল জানিয়েছেন, ‘এ দেশে রিখটার স্কেলে ৬ থেকে সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার উপযোগী ভূতাত্ত্বিক ফল্ট সংবলিত ১৪টি স্থান রয়েছে; তার মধ্যে সিলেটেই রয়েছে পাঁচটি। এসব ফল্ট থেকে যে কোন সময় মাঝারি থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। কারণ ভূমিকম্প হওয়ার জন্য যে ধরনের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও অবস্থান থাকা দরকার, ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সেসব অবস্থা রয়েছে।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মুখপাত্র (কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্পেশালিস্ট) সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বা কেন্দ্র থেকে ঢাকার দূরত্ব খুব নিকটে না হলেও, ঝুঁকির দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ঢাকা। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় করে গড়ে উঠা বেশিরভাগ নতুন ভবনে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয় বিবেচনায় রাখা হলেও পুরনো অধিকাংশ বাড়ি এখনো চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া এই শহরের ভবনগুলো নির্মাণেও ত্রুটি আছে। বেশিরভাগ ভবনই তৈরি হয়েছে জলাভূমি ভরাট করে, মাটির সক্ষমতা যাচাই করা হয়নি। মাঝারি মানের ভূমিকম্প হলেও এগুলো ভেঙে ব্যাপক প্রাণহানি হতে পারে। এমনটি ভবন নির্মাণে বিধিমালা না মানার কারণে এখন বিভাগীয় সব শহরও ভূমিকম্প ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে।’
আশরাফুল ইসলাম জানান, ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় এদেশে এখনো আন্তর্জাতিক মানের উদ্ধারকারী দল নেই, যা বিশে^র উন্নত অনেক দেশেই রয়েছে। তবে গত বছরের নভেম্বরে আমাদের ডেডবডি ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা হালনাগাদ করাসহ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেই কার্যক্রম শুরু হলে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষক এনে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট যুক্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষিত করা হবে। এছাড়া উদ্ধার তৎপরতার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পর্যায়ক্রমে আপডেড করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের সবগুলো বাহিনী প্রস্তুত করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণে নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা করা হয়েছে। এটি মানা হলে দুর্যোগের ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে। ’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, উদ্ধার কাজের জন্য সিটি কর্পোরেশনগুলোকে আলাদা আলাদা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এসব অঞ্চলে ৩৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব রয়েছে সামরিক বাহিনীগুলোরও। এছাড়া উদ্ধার কাজের সহায়তার জন্য ২০১৯ সালে ২২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে আরো যন্ত্রপাতি বাংলাদেশ হাতে পাবে। অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজ এবং দুর্যোগ মোকাবেলা কার্যক্রম শক্তিশালী করতে ২৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ তুরস্ক এবং উত্তর সিরিয়ায় ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো আটকে রয়েছে বহু মানুষ। আমাদের দেশে ২০২১ সালে পরপর কয়েকবার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সিলেট। ২০২২ সালে পাশের দেশে উৎপত্তি হওয়া ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে কেঁপেছে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলা। এসব ভূমিকম্পে তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও ভবিষ্যৎ দুর্যোগের শঙ্কা বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে ভূমিকম্প সৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকি বাড়ছে।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, সাধারণত প্রতি একশ’ বছর পর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সবশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসেবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কসহ অন্যান্য দেশের ভূমিকম্পের পর তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে অবিলম্বে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া উচিত বাংলাদেশের। কারণ এদেশ ভূমিকম্পের বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, ভূমিকম্পের সময় ও তারপর কী করণীয় সম্পর্কে মানুষকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে জাতীয় উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। এছাড়া ভূমিকম্পের পর উপকূলীয় এলাকায় সুনামির আশঙ্কা থাকে, তাই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও হাসপাতালগুলোকে স্বয়ংম্পূর্ণ করতে হবে।
বিষয়: #ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে পরিকল্পিত নগরায়নের পরামর্শ বিশেষ