রবিবার ● ৩০ এপ্রিল ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
১৮৮৬ থেকে ২০২৩। শ্রমের মর্যাদা, মূল্য ও ন্যায্য মজুরি শুধু নয়, যুক্তিসংগত কার্র্যসময় নির্ধারণের আন্দোলনের ১৩৭ বছর। গত ১৩৭ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার। কিন্তু এই প্রশ্নের আজো উত্তর খুঁজতে হয়, এতো উন্নতি-অগ্রগতি সাধিত হলেও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি? শ্রম ছাড়া যে কোন কিছুই উৎপাদন করা যায় না- এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু কর্মঘণ্টা কতক্ষণ হবে? কতক্ষণ কাজ করলে একজন শ্রমিক কত মজুরি পাবে? শ্রমিক জীবন এবং ভবিষ্যৎ শ্রম মুক্তির পরে তার সন্তানের জীবন কেমন হবে? এরকম অসংখ্য প্রশ্নের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে দাবি উঠেছিলো ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবস চাই। এই দাবির অন্তরালে ছিলো আর একটি দাবি- ৮ ঘণ্টা কাজ করে এমন মজুরি চাই যেন তা দিয়ে আমার পরিবার নিয়ে মানসম্মত জীবনযাপন করতে পারি। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি যতোই ন্যায়সঙ্গত মনে হোক না কেন, মুনাফা ও মজুরির সংঘাত এতো তীব্র যে আলোচনার পথে নয় বরং নিষ্ঠুর দমন ও রক্তাক্ত পথে সরকার ও মালিকরা সেই আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিলো।
আট ঘণ্টার কর্ম দিবসের দাবি এবং কর্ম পরিবেশ কিছুটা উন্নত হলেও আজো শ্রমিকদের পেশাগত জীবনে নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকারগুলো অর্জিত হয়নি। চলমান করোনা মহামারিতে আবারও স্পষ্ট হয়েছে- এ দেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা, মৌলিক মানবিক অধিকারগুলো কতটা ভঙ্গুর? তৈরি পোশাক শিল্পের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বেতনের দাবিতে সমবেত হচ্ছেন, বিক্ষোভ করছেন।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস- যা সচরাচর মে দিবস নামে পরিচিত। প্রতি বছর পহেলা মে তারিখে বিশ্বব্যাপী এই দিবস উদযাপিত হয়। এটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উদযাপন দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পহেলা মে জাতীয় ছুটির দিন। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়।
মে দিবস, শ্রমিক দিবস বা বিশ্ব শ্রমিক দিবস- যে নামেই ডাকা হোক না কেন, দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান-সংহতি জানানোর দিন হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে ১৯০৪ সাল থেকে। বাংলাদেশেও এই দিবসটি আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদযাপন করা হয়; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের শ্রমিকদের সমাজ কটটুকু শ্রদ্ধা বা সম্মান দেয় এ বিষয়ে এখনো নানা মতভেদ রয়েছে। কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে গণপরিবহন, হাট-বাজার, সমাজ কোন জায়গাতেই শ্রমিকদের এখনো মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না। কারণ আমরা এখনো বেশভূষা দেখেই মানষকে মূল্যায়ন করি। আমাদের দেশে এরই মধ্যে কলকারখানা পোশাকশিল্পে ঘটে যাওয়া বেশকিছু দুর্ঘটনা থেকে লক্ষ্য করা যায়, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিষয়টিতে বাংলাদেশে এখনো সন্দিহান। এছাড়াও মজুরির দিকটিতেও বাংলাদেশের শ্রমিকরা আশাহত। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও ন্যায্য মজুরি তাদের কাছে অনেকটা উচ্চাকাক্সক্ষা। বিশ্বের তৈরি পোশাক শিল্পের বড় বড় কারখানার পাঁচ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) চার দিনে যে আয় করেন, তা বাংলাদেশের একজন নারী পোশাক শ্রমিকের সারাজীবনের আয়ের সমান।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার-শহিদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লভিনে। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।
এর পরপরই ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পহেলা মে তারিখে মিছিলের শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসে ১ তারিখে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায় এবং অনেক দেশেই এটা কার্যকর হয়। দীর্ঘদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং কিছু কট্টর সংগঠন তাদের দাবি জানানোর জন্য মে দিবসকে মুখ্য দিন হিসেবে বেছে নেয়।
কোন কোন স্থানে শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে আগুনও জ্বালানো হয়ে থাকে। পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চিন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই পহেলা মে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সেসব দেশে এমনকি এ উপলক্ষ্যে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতেও এই দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে। ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। আমেরিকা ও কানাডাতে অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম দিবস পালিত হয়। সেখানকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমের নাইট এই দিন পালনের উদ্যোক্তা। হে মার্কেটের হত্যাকান্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন পহেলা মে তারিখে যেকোন আয়োজন হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সে জন্য ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দেই তিনি নাইটের সমর্থিত শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা ও নিরাপত্তা সুবিধা ও প্রত্যেক শ্রমিকের বৈধ ও আইনগত অধিকার। শ্রম আইন ২০০৬ এর অধীনে অন্তর্ভুক্ত স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো হলো- পরিচ্ছন্নতা, বায়ু চলাচল এবং তাপমাত্রা ব্যবস্থা, কৃত্রিম আর্দ্রকরণ, জনবহুলতা, আলোর ব্যবস্থা, অগ্নিসংক্রান্ত ঘটনা, অতিরিক্ত ওজন, বিল্ডিং এবং যন্ত্রপাতির উপর বা কাছাকাছি কাজ করা, বিস্ফোরক বা দাহ্য গ্যাস ও ধুলা, বিপজ্জনক ধোঁয়ার বিরুদ্ধে সতর্কতা, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
কার্মরত অবস্থায় শ্রমিকদের চোখের নিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত চশমা বা চোখের আবরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে যেখানে উৎপাদন প্রক্রিয়ার করণে উৎক্ষিপ্ত বা বিচ্ছুরিত কণা বা টুকরো থেকে অথবা অতিমাত্রায় আলো বা উত্তাপের কারণে চোখের ক্ষতির আশংকা থাকে। যেখানে শারীরিক আঘাত, বিষক্রিয়া বা গুরুতর রোগের সম্ভাবনা আছে, এমন কোন ক্ষতিকর অপারেশণের ক্ষেত্রে কর্মরত প্রতিটি শ্রমিকের জন্য সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা নিয়োগকর্তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য সরঞ্জাম দেওয়া সত্ত্বেও এটি ব্যবহার না করা হলে তার দায়িত্ব শ্রমিকের নিজের হবে।
একজন নিয়োগকর্তা তার অধীনস্ত কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ওপর একটি বাস্তব এবং প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে এবং কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য একটি সুরক্ষিত এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে বাধ্য। শারীরিক আঘাত, বিষক্রিয়া বা গুরুতর রোগের ঝুঁকি আছে- এই ধরনের বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমিক চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং কাজের জন্য উপযুক্ত প্রমাণিত না হলে তার দ্বারা ওই কাজ করানো যাবে না। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি এবং পর্যবেক্ষণ কাজে পরিদর্শকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই মে দিবস সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন দিনটি পালন করতে শোভাযাত্রা, শ্রমিক সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকে। মে দিবসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক ফেডারেশন সহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক কর্মসূচি পালন করে।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। একটি দেশের উন্নয়নের অন্তরালে থাকে শ্রমিক-মজুরদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ব্যাথা-বেদনা। কিন্তু সে অনুযায়ী শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে না। যাদের ঘামে একটি একটি ইট সাজিয়ে বড় বড় ইমারত সদৃশ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া আবশ্যক। শ্রমিকদের যথাযথ মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হতে হবে সব শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হোক সুপ্রতিষ্ঠিত এবং পৃথিবী হোক শান্তিময়। বর্তমান সরকার শ্রমিক বান্ধব সরকার। সরকার শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যার ফলে শ্রমিকরা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক প্রতিষ্ঠানেই এখন কাজের পরিবেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমান সরকারের ধারাবহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। তাহলে শ্রমিকরা আরও উন্নত জীবন পাবে।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
বিষয়: #আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস