মঙ্গলবার ● ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
প্রচ্ছদ » জাতীয় » ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত হচ্ছে পর্যটন মহাপরিকল্পনা
ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত হচ্ছে পর্যটন মহাপরিকল্পনা
বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২২ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন
ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার পরও বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশে^র অন্য দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। স্বাধীনতা-পরবর্তী দীর্ঘ পাঁচ দশকে এ খাতের সমস্যা, সংকট ও সম্ভাবনার নানা দিক নিয়ে স্বদেশভূমি’র সাথে কথা বলেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন বিশেষ প্রতিনিধি শাহনাজ পারভীন এলিস।
- একাত্তরে দেশ স্বাধীনের পর দীর্ঘ ৫০ বছরে এদেশে পর্যটন খাতও ৫০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে এ খাতে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে আপনি কীভাকে মূল্যায়ন করবেন?
- মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে এদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন প্রতিষ্ঠাসহ নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সময়ে টানা ২০ বছর বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলো স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি দোসররা। তারা কারা? তারা হলেন যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তান সরকারের দোসর বিএনপি-জামায়াত জোট। ফলে এদেশে অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বহির্বিশে^ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ রয়েছে অসংখ্য হাওড়, নদীনালা, খালবিল ও নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এদেশে- পর্যটন খাতের বিকাশমান ধারা মুখ থুবড়ে পড়ে। কারণ সাম্প্রদায়িকতা সেসময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। এদেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদী ওই গোষ্ঠী কখনো চায়নি ভিনদেশী ভাষা সংস্কৃতির মানুষ এদেশে ভ্রমণ করতে আসুক। আমাদের দেশের সংগ্রাম এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য বহির্বিশ্বে মানুষ জানুক। আমি মনে করি সেই সময়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি পর্যটন শিল্পের বিকাশের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দীর্ঘ পাঁচ দশকেও আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি।
- বিগত ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দেশ শাসন করছে। এই সময়েও তো এ খাতে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় তলানিতে, কেন?
- এটা ঠিক যে বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। কারণ দীর্ঘ সময়ের ঘুণেধরা জঞ্জাল তো আর অল্প সময়ে দূর করা সম্ভব হয় না। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলেই এদেশের পর্যটন খাত বিশ্বে ঘুরে দাঁড়নোর চেষ্টা করছে। দেশের বিকাশমান পর্যটন কেন্দ্র ও স্থাপনাগুলো সম্পর্কে প্রচারণায় এখনো আমাদের ঘাটতি রয়েছে, যা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চলছে। আমরা সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সেই পর্যটন মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে পারবো।
- পর্যটন শিল্পের বিকাশে এখনো ধরনের সংকট ও বাধা রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
- আসলে এ খাতে কোন মহাপরিকল্পনা না থাকায় বিগত দিনগুলোতে উন্নয়ন কর্মক্রমগুলো চলেছে বিচ্ছিন্নভাবে। অনেক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলেও, সেসব স্থানে পৌঁছানো জন্য ভালো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। আমি মনে করি এ শিল্পের অগ্রগতির সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। কারণ সুসজ্জিত কেন্দ্র আপনি স্থাপন করলেন কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত না হলে পর্যটকরা সেসব স্থানে যেতে আগ্রহ বোধ করেন না। এছাড়া বিদেশি পর্যটকদের ক্ষেত্রে ভিসা প্রসেস নিয়ে জটিলতা এখনো কাটেনি। আসলে ভিনদেশী মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা বোধ তৈরি করা সম্ভব না হলে বিদেশি পর্যটকদের আস্থায় আনা যাবে না। আমাদের পর্যটন শিল্পের বিকাশমান ধারা বহাল রাখাও সম্ভব হবে না। তবে এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ এবং করণীয় নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে মহাপরিকল্পনায়।
- গত ২০২০-২১ সালে কোভিড-১৯ মহামারিতে পর্যটন খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি সে অবস্থার উন্নতি হলেও করোনার প্রভাব আসলে কতটা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে?
- করোনা মহামারিতে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ^ব্যাপী এ খাতে মহাবিপর্যয় ঘটেছে। চলতি বছর সে প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আসায় স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে পর্যটন কেন্দ্রগুলো পরিচালনায় সব ধরনের বাধা-নিষেধ উঠে গেছে। দেশের সব পর্যটন স্থানগুলোতে পুনরায় দর্শনার্থীর আনাগোনায় মুখর হয়ে উঠেছে। স্থবিরতা কাটিয়ে এ শিল্পে গতিশীলতা ফিরে এসেছে। তবে আগত পর্যটকদের বেশিরভাগই দেশি; বিদেশি পর্যটক আগমন বাড়ানো সম্ভব হয়নি; পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, চেষ্টা অব্যাহত আছে।
- বিভিন্ন সরকারের আমলে পর্যটন করপোরেশনের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে দেওয়া হয়। সেগুলো নিজেদের আওতায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোন অগ্রগতি কী আছে?
- হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্যাফেটেরিয়া ও বারসহ পর্যটন করপোরেশনের মোট ৪৭টি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪টি ইউনিট পরিচালনা করছে করপোরেশন। বাকি ১৩টি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। গত ২০০০ সালের ২৮ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় পর্যটন পরিষদের প্রথম সভায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত পর্যটন করপোরেশনের ইউনিটগুলো ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর কক্সবাজারের মোটেল লাবণী, রাঙামাটির পর্যটন বার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় পর্যটন করপোরেশন। কিন্তু এখনো ১০টি রেস্তোরাঁ ও বার, একটি সুইমিংপুল, একটি লেক ও একটি পার্ক নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলেও চেষ্টা অব্যাহত আছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- শাহবাগের সাকুরা রেস্তোরাঁ ও বার, মহাখালীর রুচিতা রেস্তোরাঁ ও বার, নারায়ণগঞ্জের মেরি অ্যান্ডারসন ভাসমান রেস্তোরাঁ ও বার, চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী গলফ ক্লাব বার ও চট্টগ্রামের ফয়’স লেক।
- দেশের পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে আপনার মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা- বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন-বাপক ও বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড- বিটিবি কাজ করে। তাদের কাজ ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আপনার মন্তব্য কী?
- এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন মনে করছি। এ সেক্টরের সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তাদের মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে। সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বাপক ও বিটিবি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনায় শামিল হয় ঠিকই, কিন্তু তাদের কাজে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয় না। সম্প্রতি পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোকে উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় আনা হচ্ছে, কাজ চলছে।
- বেসামরিক বিমান পরিবহন পর্যটন খাতে কী ধরনের সহায়ক রাখছে। আকাশ পথে ভ্রমণে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে নতুন কোন পরিকল্পনা কী রয়েছে?
- বিমান পরিবহন পর্যটন খাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কারণ এর ফলে পর্যটকদের কাক্সিক্ষত স্থানে ভ্রমণ করতে যাতায়াতের সময় অনেক সাশ্রয় হচ্ছে। সিলেটে নতুন বিমানবন্দর স্থাপন করা হয়েছে। পুরনো বিমানবন্দরগুলোর আধুনিকায়ন, আবার কোন কোন বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। অনেকের ধারণা- বিমানে আমরা রুজি করি, বেতন দিই ও বিমান কিনি। সরকারি টাকা দিয়ে আমরা বিমান কিনি, পর্যটনকে দিই না। এটি ভুল ধারণা। পর্যটনেও আমরা রুজি করেই বেতন দিই। এছাড়া আরও কীভাবে পর্যটনকে সাপোর্ট দেয়া যায়, সেই চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
- পর্যটন খাতে নারীর কর্মসংস্থান এখনো খুব সামান্য। এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ, আর্থিক সচ্ছলতা ও ক্ষমতায়নে আপনাদের কোন পরিকল্পনা আছে কী?
- পর্যটনশিল্পে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নে আমাদের দুই সংস্থা বাপক-বিটিবি বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসেনি। কারণ পর্যটন খাত সম্পর্কে এদেশের মানুষের ভ্রান্ত ধারণা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গি, সংশ্লিষ্ট খাতে প্রশিক্ষণ না থাকায় পর্যটনসংশ্লিষ্ট এ খাতে কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। তবে আগ্রহী নারী-পুরুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
- কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে নিরাপত্তা নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন উঠছে। এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যা জানতে চাই?
- দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে প্রচার হওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ ধরনের অভিযোগ উঠা মোটেই যৌক্তি মনে করছি না। কারণ পর্যটকরাই হলেন পর্যটন স্থান ও কেন্দ্রর প্রাণ। কাজেই তারা যদি বেড়াতে গিয়ে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন তাহলে সেসব স্থানে যেতে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন- এটা পর্যটন খাতের সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোক্তাই জানেন। তাই দর্শনার্থী ও পর্যটকদের নিরাপত্তায় সব পর্যটন এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়া আছে। কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটাসহ সনামখ্যাত পর্যটন স্থানকে ঘিরে পর্যটকদের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনে ট্যুরিস্ট পুলিশের সংখ্যা আরও বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া আছে।
- বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে স্বদেশভূমিকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
- স্বদেশভূমি পরিবারের প্রতি রইলো শুভকামনা। দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে এ খাতের বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রচারে সংবাদ সারাবেলা আরও ভূমিকা রাখবে- এই আশাবাদ রাখছি।
বিষয়: #বিশেষ সাক্ষাৎকারে পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী