শনিবার ● ২৯ অক্টোবর ২০২২
প্রচ্ছদ » জাতীয় » বিশ্বে দেড় কোটি, বাংলাদেশে ২০ লাখ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত
বিশ্বে দেড় কোটি, বাংলাদেশে ২০ লাখ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত
# দেশে প্রতি ৪ জনে একজন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে
# বিশ্বে বছরে দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত
# স্ট্রোকের ৫০ শতাংশ রোগীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়
# স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি ৪০ ও ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের
# চিকিৎসায় প্রতি বছর দরিদ্র হয় ৬৪ লাখ মানুষ
শাহনাজ পারভীন এলিস
ঢাকার মগবাজারের মধুবাগ এলাকার বাসিন্দা আজগর আলী (৬৫) গত সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখে রাতে হঠাৎই বুকে ব্যাথা অনুভব করেন। এরপর বাথরুমে গিয়ে সেখানে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরিবারের সদস্যরা তাকে দ্রুত মগবাজার ওয়্যারলেসগেটের কমিউনিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলেও চিকিৎক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হৃদরোগের পর বাংলাদেশে স্ট্রোক এভাবেই মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। দেশে প্রতি ৪ জনের মধ্যে একজন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন। আর বছরে স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও পঙ্গুত্বের অন্যতম প্রধান কারণও হলো স্ট্রোক। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের ২০১৮ সালের এক জরিপের তথ্য বলছে, দেশে প্রতি হাজারে স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন ১১ দশমিক ৩৯ জন মানুষ; যা প্রায় ২০ লাখের মতো। আর ৬০ বছরের বেশি মানুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ৭ গুণ বেশি।
এমনই বাস্তবতায় শনিবার (২৯ অক্টোবর) বিশ্বজুড়ে পালিত হলো বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্রতি মিনিট জীবন বাঁচায়’। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে স্ট্রোক। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ। এর পরেই স্ট্রোক। বাংলাদেশে স্ট্রোকে মৃত্যুর হার চার গুণ বেড়েছে। এতে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন।
অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে বছরে দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকজনিত সমস্যায় ভোগে। এর মধ্যে স্ট্রোকে মৃত্যু হয় প্রায় ৫০ লাখের। বাকিদের অনেকেই স্ট্রোকের কারণে পক্ষাঘাতজনিত সমস্যায় ভোগেন। এই রোগীরা পরিবারের বোঝা হয়ে যান। চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। তবে শিশুদেরও স্ট্রোক হতে পারে।
বিএসএসএমইউ’র সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া সংবাদ সারাবেলাকে জানিয়েছেন, ‘এই চিকিৎসা দিতে হবে ঘটনার সাড়ে ৪ ঘণ্টার ভেতরে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রোগীরা সাড়ে ৪ ঘণ্টার ভেতরে আসেন না। কারণ, রোগীরা বুঝতে পারে না যে তার স্ট্রোক হয়েছে। শুধুমাত্র যথাসময়ে চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে আক্রান্ত রোগীর প্রতি মিনিটে প্রায় ২০ লাখ কোষ মারা যায়। কিন্তু সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি তাকে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়, তাহলে ঝুঁকি হ্রাস পায়।’ তাই স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হলে রোগীকে বাঁচানো ও পঙ্গুত্ব্বের ঝুঁকিও কমানো সম্ভব বলে জানান তিনি।
ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া আরও বলেন, ‘আমাদের মাথা পিছু আয় বেড়ে যাওয়ার কারণে জীবনযাপন উচ্চাভিলাষী হয়ে গেছে। এতে মানুষ আরাম প্রিয় হয়েছে। শারীরিক অ্যাক্টিভিটিজ নেই। এখান থেকে ওখানে গাড়িতে চড়ে যায়। এখন রিচ ফুড, ফাস্ট ফুড মানুষ খায় বেশি। এতে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের রোগী বাড়ছে, কোলেস্টেরল বাড়ছে, মদ খাওয়া, ধূমপায়ী বাড়ছে। এতে কিন্তু ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত ওজন যাদের তাদেরও ঝুঁকি বেশি। এই ঝুঁকি যত বেশি কমানো যাবে, তত বেশি স্ট্রোকের সংখ্যা কমবে।’
ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন জানিয়েছে, স্ট্রোক হওয়ার৩ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা নিলে ৩০ শতাংশ রোগীর সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্ট্রোক হওয়ার ৬ ঘণ্টার ভেতরে রক্ত নালীর জমাট খুলে দিলে ৫০ শতাংশ রোগীর সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন, স্ট্রোক হওয়ার পরে রিং পরানোর মাধ্যমে রক্ত নালীর ব্লক খুলে দেওয়া সম্ভব। স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীরা স্ট্রোক সেন্টারে চিকিৎসা নিলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ১৪ শতাংশ।
বিগতদিনে ধারণা ছিল স্ট্রোক শুধু বয়স্ক ব্যক্তিদের হয়। তবে সেই ধারণা এখন পরিবর্তন হয়েছে। করোনা মহামারি আসার পর তরুণদেরও স্ট্রোকের সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও বেড়েছে। সম্প্রতি কুমিল্লার বাসিন্দা বালু উত্তোলন শ্রমিক সুমন (৩১) কর্মরত অবস্থায় হঠাৎ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এতে তার মস্তিষ্কের বাম পাশে রক্ত জমাট বাঁধে। একপাশের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার আরেক পাশ দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রথমে কুমিল্লা হাসপাতালে নেয়া হয় সুমনকে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সুমনকে ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেলের নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুমন রানা বলেন, ‘এত দিন সবার ধারণা ছিল স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) শুধু বয়স্ক ব্যক্তিদের হয়। তবে সেই ধারণা এখন পরিবর্তন হয়েছে। করোনার মধ্যে তরুণদের স্ট্রোকের সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও বেড়েছে। মাসে কিংবা বছরে কত সংখ্যক তরুণ রোগী এই হাসপাতালে সেবা নিতে আসেন, সেই পরিসংখ্যান নেই তাদের কাছে। তবে আগের তুলনায় কম বয়সীদের সেবা নেয়ার হার অনেক বেড়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকান নিউরোলজি একাডেমির প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত তরুণদের মাঝে স্ট্রোকের হার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনার ফলে স্ট্রোকে আক্রান্ত তরুণদের ৫০ ভাগ রোগীর স্ট্রোকের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার সময় জ্বর-কাশি শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ ছিল না। এছাড়া তরুণদের ক্ষেত্রে স্ট্রোক করোনার প্রথম লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, স্ট্রোক দুই ধরনের। রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং রক্তনালি ফেটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। স্ট্রোকের লক্ষণগুলো হলো শরীরের ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে চোখে কম দেখা, মাথা ঘোরানো, অচেতন হয়ে পড়া, শরীরের এক দিক অবশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
বিদেশে স্ট্রোক সেন্টারে চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই চালু থাকলেও বাংলাদেশে এটি নতুন ধারণা। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল এবং বিএসএমএমইউ-তে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালেও এই চিকিৎসা চালু হয়েছে।
চিকিৎসকদের মতে, যারা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খায়, সেটি অনিয়মিত হলে স্ট্রোকের হওয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। এই রোগে নারীর চেয়ে পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ। স্ট্রোকের প্রকোপ শহরের চেয়ে গ্রামে কিছুটা বেশি। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে দেওয়া স্ট্রোকের ঝুঁকিতে পড়ার অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশে স্ট্রোক চিকিৎসার ব্যয় সম্পর্কে পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম মোজাহেরুল হক বলেছেন, চিকিৎসার জনগণ ৬৩ শতাংশ নিজের পকেট থেকে দেয়, বাকি ৩৭ শতাংশ সরকার দেয়। স্ট্রোকের অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ বিরাজমান সরকারি চিকিৎসা যা আছে সেটা স্ট্রোকের জন্য অপ্রতুল। কারণ স্ট্রোক ডায়াগনোসিস হওয়ার পরবর্তী ৬৩ শতাংশ ব্যয় নিজের পকেট থেকে যায়। কিন্তু সবাই এ ব্যয় বহন করতে পারেন না। এই কারণে স্ট্রোকের রোগীদের অনেকের মৃত্যু হয়। এভাবে চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রতি বছর ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে।
টিএমএমএস’র প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. হোসনে আরা বেগম জানিয়েছেন, স্ট্রোক মরণঘাতি একটি রোগ। এ ধরনের রোগে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া উত্তম। তাহলে খরচ কমে যাবে আমাদের খাদ্যাভ্যাস, লাইফ স্টাইল, পরিবর্তন করতে পারলে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব। অন্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে মানুষের কাছে পরিষ্কার ধারণা থাকলেও স্ট্রোক সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। একইসাথে মানুষ স্ট্রোক হওয়ার পরপরই কোথায় গেলে চিকিৎসা পাবে এবং কী চিকিৎসা হতে পারে সে বিষয়ে বুঝে উঠতে পারে না।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আশঙ্কা, করোনায় আক্রান্ত উপসর্গহীন তরুণদের অর্ধেকই ব্রেইন স্ট্রোকে ভুগতে পারেন। ৩০ বছর বয়স্ক মৃদু করোনায় উপসর্গসহ রোগীরা স্ট্রোক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, স্ট্রোক মৃত্যুর দ্বিতীয় ও অক্ষমতার তৃতীয় কারণ। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৭০ ভাগ দেশেই স্ট্রোকের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এসব দেশে ৮৭ ভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যু ও অক্ষমতার প্রধান কারণ এই রোগ। বিশ্বে প্রতিবছর দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, যাদের ৩০ ভাগই মারা যায়। আর প্রায় ৬০ ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়।
চিকিৎসকদের মতে, ৯০ শতাংশ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মমাফিক জীবন যাপন করলে। আশার কথা হলো, দ্রুত চিহ্নিত করতে পারলে ৭০ শতাংশের বেশি রোগী এর মারাত্মক ছোবল থেকে রেহাই পেতে পারে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৮ কোটি মানুষ স্ট্রোক থেকে সুস্থ হয়েছে।
বাংলাদেশেও বাড়ছে স্ট্রোকের রোগীর সংখ্যা। ঢাকা মেডিক্যালের নিউরো সায়েন্স বিভাগের করা গবেষণা বলছে, দেশে ৪০ বছরে রোগটির তীব্রতা বেড়েছে শতভাগ। বর্তমানে প্রতি চারজনে একজন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে রয়েছেন। উল্টোদিকে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে স্ট্রোকের মাত্রা কমেছে ৪২ শতাংশ। ২০৫০ সালে বিশ্বে স্ট্রোকের মোট রোগীর ৮০ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।